ইনসাইড টক

`ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো বিবেচনায় নিতে হবে`

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 28/09/2020


Thumbnail

আজ আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্য অধিকার ও করোনাকালে গণমাধ্যমের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে বাংলা ইনসাইডারের সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি এবং টিভি টুডের এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডারের নিজস্ব প্রতিবেদক মির্জা মাহমুদ আহমেদ

বাংলা ইনসাইডার: বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং তথ্য অধিকার কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন?

মনজুরুল আহসান: বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন আছে যেমন, তেমনি অপআইনও আছে। ‘ভালো না এমন আইনও আছে’। আইনের অপব্যবহার যেমন আছে তেমনি আইনের প্রায়োগিক সমস্যা আছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে আন্তর্জাতিকভাবে বলা হয় ‘আংশিক স্বাধীনতার’ গণমাধ্যম। আংশিক স্বাধীন গণমাধ্যম বলার কারণ হচ্ছে এখানে সাংবাদিক হত্যা কিংবা নির্যাতনের শিকার হলে কোনো বিচার হয় না। বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে প্রায় দেড় ডজনের বেশি সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। অনেক সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন যার কোনো বিচার হয়নি।

বাংলা ইনসাইডার: করোনাকালে গণমাধ্যম একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার উপায় কী?

মনজুরুল আহসান: করোনাকালে গণমাধ্যমের সংকট দুইভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়। প্রথমত যারা গণমাধ্যমের মালিকানায় আছেন তারা সাংবাদিক, শ্রমিক, কর্মচারীদের সুরক্ষা দেবেন। স্বাস্থ্যগতভাবেও সুরক্ষা দেবেন চাকরিগতভাবেও সুরক্ষা দেবেন। মালিকপক্ষ বলতে চান; তাদের বিজ্ঞাপন কমে গেছে, তাদের আয় কমে গেছে। এজন্য তারা সাংবাদিকদের চাকুরিচ্যুত করছেন। একটা ব্যবসায় কখনো ভালো কখনো মন্দ থাকবে। এই যুক্তিতে চাকুরিচ্যুতি গ্রহণযোগ্য নয়। ভালো সময়ে তো আপনি বেতন বাড়ান না খারাপ সময়ে আপনি চাকুরিচ্যুতি করবেন কেন? আর সরকারকে শিল্প হিসেবে গণমাধ্যমকে সহায়তা দিতে হবে।
গণমাধ্যমের কী সমস্যা আছে সেটা নিরুপণ করে সহায়তা দিতে হবে। সরকার যেমন করোনাকালে গামের্ন্টস মালিকদের প্রণোদনা দিয়েছে; তেমনি করে গণমাধ্যম মালিকদের সঙ্গে বসতে পারে। গণমাধ্যম মালিকদের কোনো প্রণোদনা দরকার আছে কি না, স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদী কোনো ঋণ দরকার আছে কি না সে ব্যাপারে জানতে পারে। আমাদের সংবাদপত্রের হকার যারা, যারা পত্রিকা বিতরণ করে করোনাকালে তারা তিন মাস বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। তারাও তো সংবাদপত্র শিল্পের অংশ। আমি মনে করি গণমাধ্যমের মালিকপক্ষকে সাংবাদিক, শ্রমিক, কর্মচারীদের সুরক্ষা দিতে হবে। আবার গণমাধ্যম শিল্পকে বাঁচাতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুমাত্র সাংবাদিকদের ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিল এটা একটা অংশ হতে পারে। সাংবাদিক ছাড়াও গণমাধ্যমে আরো অনেক অংশ আছে তাদের সবাইকে সুরক্ষা দিতে গণমাধ্যম মালিকদের পাশাপাশি সরকারকেও পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলা ইনসাইডার: বর্তমান সময়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর ফলে খুব সহজে গুজব ছড়ানো যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?  

মনজুরুল আহসান: প্রথম কথা হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দুটোকে একভাবে দেখলে চলবে না। মূলধারার গণমাধ্যম হচ্ছে সংবাদ মাধ্যম কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদ মাধ্যম না। আপনি যখন সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেন তখন আপনাকে পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো পেশাদারিত্ব নেই আপনি যা খুশি লিখতে পারেন। কাজেই আমি মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের তুলনা করি না। আমি মনে করি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটা নতুন ধারার মাধ্যম। এখানে প্রযুক্তি আছে। দ্রুত প্রচারের ক্ষমতা আছে। কাজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের আরো দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

মূলধারার গণমাধ্যমে যে প্রাতিষ্ঠানিকতা আছে; এখানে সম্পাদক আছে, সাংবাদিক আছে তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই সুযোগ নেই। যার ইচ্ছা কাউকে গালি দিল, কোনো অপতথ্য প্রচার করল। কাজেই আমি মনে করি সামাাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি ইতিবাচক দিক হলো এর প্রযুক্তিগত দিকটি খুব ভালো। এর গতি খুব ভালো, দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে কিন্তু এর নেতিবাচক দিক হলো এর মাধ্যমে অপতথ্য প্রচারের সুযোগ থাকে, ভিত্তিহীন তথ্য প্রচারের সুযোগ থাকে, মানুষের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সুযোগ থাকে, ভুল সংবাদ প্রচারের সুযোগ থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যদি সাংবাদিকতার সাথে থাকতে চায় তাহলে তাদের মেইনস্ট্রিম সাংবাদিকতার যে ব্যাকরণ আছে, দায়িত্ববোধ আছে, নীতি আছে এগুলো তাদের মানতে হবে। সেটা করা না হলে শুধু অপতথ্য প্রচারের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে শক্তি আছে সে শক্তি মাধ্যমটি হারিয়ে ফেলবে।

আমি মনে করি ভুল-ত্রুটি, ভালো-মন্দ মিলিয়ে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো এখনো মানুষের আস্থার জায়গায় আছে।
বাংলাদেশের দিক থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচার আছে ব্যাপক। বহু লোক এটা ব্যবহার করেন কিন্তু আস্থার জায়গায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর মূলধারার গণমাধ্যম এক জায়গায় আছে বলে আমি মনে করি না। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন, তাদের বিষয়বস্তুর দিক থেকে আরো সর্তক হতে হবে। যাতে ভুয়া তথ্য, ভুল তথ্য, অপতথ্য, অপমানজনক তথ্য যাতে তারা প্রচার বা শেয়ার না করেন।

বাংলা ইনসাইডার: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিক নেতাদের আপত্তি ছিল……..

মনজুরুল আহসান: সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটা আইন থাকা দরকার। কিন্তু সে আইনের মধ্যে এমন কোনো ধারা, এমন কোনো বিষয় থাকা উচিত না; যেটি পেশাদার সাংবাদিকদের হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করা হয়েছে, সেখানে এমন কিছু ধারা আছে, এমন কিছু বিধান আছে যে বিধানগুলো পেশাদার সাংবাদিকদের ঝুঁকির মধ্যে, হুমকির মধ্যে ফেলছে।

করোনাকালীন আমরা দেখেছি যখন সাংবাদিকরা জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ বিতরণের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেছেন, হাসপাতালে অনিয়মের বিরুদ্বে রিপোর্ট করেছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে রিপোর্ট করেছে তখন এই আইনের অপপ্রয়োগ আমরা দেখেছি। কাজেই আমি মনে করি সাইবার অপরাধ দমনে আইন থাকা দরকার কিন্তু সে আইন যাতে পেশাদার সাংবাদিকদের ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে সেটি দেখতে হবে। যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয় তখন আমরা সরকারকে বলেছিলাম আইনটির অপপ্রয়োগ হবে। সরকার বলেছিল আইনটি অপপ্রয়োগ হবে না । কিন্তু এখন অপপ্রয়োগ হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা বিবেচনা করতে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম। সরকার বলেছিল এসবের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা এখন দেখতে পারছি সেই ধারাগুলো দিয়ে পেশাদার সাংবাদিকদের নির্যাতনের মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে। আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে অংশটুকু গণমাধ্যমকর্মীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে সেই অংশটুকু বিবেচনায় নিতে হবে।  

 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭