ইনসাইড টক

সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগের কারণে প্রবাসী আয় বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 05/10/2020


Thumbnail

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফেরত যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ও কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তাই প্রবাসী আয় নিয়েও শঙ্কা জেগেছে অনেকের মনে। এসব বিষয় নিয়ে বাংলা ইনসাইডারের সাথে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডারের নিজম্ব প্রতিবেদক মির্জা মাহমুদ আহমেদ

বাংলা ইনসাইডার: সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী আয়ে রেকর্ড দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে কি কারণ আছে বলে মনে করেন?

ড.আতিউর রহমান: সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় আশাতীত হারে বাড়তে দেখছি। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত: সরকার গতবছর রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সেটা খুব কাজে দিয়েছে। 
দ্বিতীয়ত: প্যানডেমিকের কারণে বিদেশ থেকে লোকজনের আসা যাওয়া কমে গিয়েছিলো। এর ফলে হুন্ডি কমে গিয়েছে। হুন্ডি কমে যাওয়ার কারণে অনেকে আনুষ্ঠানিক পথে এখন টাকা পাঠাচ্ছেন। 
তৃতীয়ত: অগ্রণী ব্যাংকসহ কোন কোন ব্যাংক সরকারের ২ শতাংশ প্রণোদনার ওপর অতিরিক্ত আরও এক শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এই কারণে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রবাস আয়ের ক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংক এখন এক নম্বর অবস্থানে আছে। এছাড়াও প্রবাসীরা যাতে কর্মস্থল থেকেই টাকা পাঠাতে পারেন এজন্য অগ্রণী ব্যাংক একটি আধুনিক অ্যাপস চালু করেছে। অনেক দেশ থেকেই এখন অবশ্য ডিজিটাল অ্যাপস ব্যবহার করে প্রবাস আয় বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।
মালয়েশিয়া থেকে টাকা পাঠানো আরও সহজ করতে স্ট্যানচার্ট ব্যাংক ও বিকাশের আর্থিক সেবার মাধ্যমে  প্রবাস আয় সংগ্রহের একটি ডিজিটাল উদ্যোগ সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন পেয়েছে। এটিও অ্যাপভিত্তিক একটি উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকেও নানা ধরনের অ্যাপের ব্যবহার বাড়িয়ে অর্থ লেনদেনকারি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাস আয় পাঠাচ্ছে। এই অর্থ আবার আমাদের প্রান্তে মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে খুব দ্রুত প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌছে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ডিজিটাল অর্থ লেনদেনের যে বিপ্লব ঘটিয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকার তার সুফল পাচ্ছেন পুরো দেশের মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংক গত দশক ধরেই এ কাজে সম্পূরক ভূমিকা পালন করে আসছে।
চতুর্থত; বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারগুলো বাজার থেকে কিনে নিচ্ছে। যার ফলে একদিকে যেমন বাজারে তারল্য বাড়ছে;অন্যদিকে টাকার মূল্যও স্থিতিশীল থাকছে। বিনিময় হারটা স্থিতিশীল থাকছে বলেই প্রবাসীদের দু:শ্চিন্তা কমেছে।
পঞ্চমত;যারা বিদেশে আছেন তারা সব সময় দেশের কথা ভাবেন। দেশের মানুষের তথা আত্মীয়-স্বজনের কস্টের কথা ভাবেন। এজন্য বন্যা এবং করোনার সময়টাতে দেশে থাকা স্বজনদের জন্য তারা বেশি বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন।নিজেরা কম খরচ করে কম খেয়ে তারা তা করছেন।


প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম নীতিও করোনাকালে অনেক সহজ করেছে। ৫০০০ ডলার পাঠালে এখন বাড়তি কোন কাগজপত্র চাইছে না ব্যাংকগুলো। জাতীয় পরিচয়পত্র বা এমএফএস হিসেবের পিন নাম্বার দিয়েই টাকা তুলে নিতে পারছেন উপকারভোগীরা। পাঁচ হজার ডলারের ওপরে পাঠাতে হলে চাকরির কাগজপত্র বা আয়ের উৎস’র কাগজপত্র তাদের উপকারভোগীদের মাধ্যমে ব্যাংকের কাছে প্রর্দশন করতে হয়। কাগজপত্র জমা দেয়ার প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। সময় সীমাও বাড়ানো হয়েছে। আগে এক সপ্তাহের মধ্যে কাগজপত্র দেখাতে হতো। এখন দুমাসের মধ্যে করলেই হয়। আসলে নিয়ম নীতি সহজ করাও যে এক ধরণের প্রণোদনা তা বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পেরেছে।


এছাড়াও আগামী ১৬ তারিখ থেকে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে অনলাইনে ট্রেজারী বন্ড কিনতে পারবেন। সরকারী বন্ডে যে পরিমাণ ইন্টারেস্ট প্রবাসীরা পাবেন বিদেশের কোন ব্যাংকে তার কিয়দাংশও পাবেন না। সেখানে এত ইন্টারেস্ট দেয়া হয়না। যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যে থাকা স্বচ্ছল প্রবাসীরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে এখন এই বন্ডগুলো অনেক বেশি কিনবেন।
প্রতিটি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হয় এমন শাখাগুলোতে ( এড শাখা) যাতে প্রবাসীরা ফরেন একচেঞ্জ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন এবং বন্ডসহ অন্যান্য লেনদেন করতে পারেন সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম-নীতি এরই মধ্যে অনেকটাই সহজ করেছে। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব ইতিবাচক উদ্যোগের কারণে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ হালে বেশ বাড়ছে। 
অনেকেই ধারণা করেছিলো করোনাকালে প্রবাসী আয় কমে যাবে। সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়ার কারণে উল্টো প্রবাসী আয় আরও বেড়ে গেছে। গত তিন মাসে এই আয় গত বছরের ঐ সময় থেকে ৪৮ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।

বাংলা ইনসাইডার: প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেয়া দিয়েছে। এই অনিশ্চয়তা রেমিট্যান্স প্রবাহে কোন প্রভাব ফেলবে কী?

ড.আতিউর রহমান: প্যানডেমিকের কারণে প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। যারা বিদেশ থেকে এসেছিলেন তারা এখন  ফিরে যেতে খানিকটা সমস্যায় পড়েছেন। ভিসা মিলছে তো টিকেট মিলছে না। টিকেট মিলছে তো ভিসা মিলছে না ।এ ধরনের কিছু সমন্বয়হীনতা আমরা দেখতে পারছি। একটা সংকটকালে এরকম সমস্যা হতেই পারে। 
সমস্যাটার উৎস চিহ্নিত করে কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। সরকার বসে নেই। নানা ভাবে চেষ্টা করছে। তবে অস্বাভাবিক সময়ে ‘আউট অব বক্স’ ব্যবস্হা গ্রহন করাটা দোষের নয়। 

দরকার হলে দেশি বিদেশি ফ্লাইট বাড়িয়ে প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফেরত পাঠানো যেতে পারে। করোনা পরীক্ষা সহ যেখানেই সংকট সেখানেই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখেন যারা সেই মানুষগুলো কেন এত হয়রানির শিকার হবেন সে প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। যারা এত কষ্টের মধ্যে আমাদের জন্য অর্থ পাঠান তাদের জন্য অবশ্যই আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। পুরো বিষয়টাকে দ্রুত একটা শৃংঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। 
৮০ শতাংশ প্রবাসীই গ্রামের সাধারন মানুষ। তাদের দিকে আমাদের বিশেষ নজর রাখতে হবে। 

তবে এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটি ইতিবাচক দিক চোখে পড়ে। আর তা হচ্ছে-বাংলাদেশের মানুষ আসলেই লড়াকু।

এমন সংকট কালেও তারা কাজে যোগদানের জন্য মরিয়া। নিজের আত্মীয় স্বজন ও দেশের জন্য কিছু করার আগ্রহ তাদের প্রবল। একেই বলে দেশপ্রেম। এরা আমাদের অর্থনেতিক মুক্তিযোদ্ধা। তাদের ইচ্ছে শক্তির জোরেই বাংলাদেশ শত চ্যালেন্জ পায়ে দলে তরতর করে এই করোনাকালেও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আর সেজন্যেই তাদের দিকে সরকারের বিশেষ নজর দেবার প্রয়োজন রয়েছে।তাদের কষ্ট লাঘবে যা যা দরকার তাই করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুত থাকতে হবে। মনে রাখা চাই প্রবাস আয় আমাদের অর্থনীতির শিকড়কে শক্তিশালী করছে। তাই সেই শিকড়ে পানি ঢালতে আমাদের গড়িমসির কোনো সুযোগ নেই।

প্যান্ডেমিকের কারণে যেসব প্রবাসী চাকরি-বাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা যেন দেশে এসে বিপাকে না পড়েন এজন্য সরকার দুই হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করেছে। তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করার জন্য তা করা হয়েছে। তাছাড়া যারা কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলে আবার যাতে ফেরত পাঠানো যায় সেই সুযোগগুলো তৈরি করাও এই কর্মসূচির আরেকটি উদ্দেশ্য।
যারা সম্পদশালি প্রবাসী তাদের দেশে বিনিয়োগ করতে আহবান করতে হবে। আমাদের স্পেশাল ইকোনমিক জোন হচ্ছে, বিনিয়োগবান্ধব নানা ধরনের কর্মকান্ড হচ্ছে। একটু ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাদের মাতৃভূমিতে বিনিয়োগের  উদ্যোগ নেবার আহবান জানাচ্ছি। চীনে কিন্তু এধরনের বিনিয়োগই বেশি হয়েছে। এমন কি তাইওয়ান থেকেও চীনে প্রচুর বিনিয়োগ এসেছে। নাড়ির টান বলে কথা।

এছাড়াও প্রবাসী প্রফেশনালস যারা আছেন,বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ার যারা আছেন তাদেরকেও বাংলাদেশে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। আমরা এখনও বিদেশ (ভারত থেকে শ্রীলংকা ) থেকে অনেক পেশাজীবী আমাদের আমদানী করতে হয়। আমরা যদি নিজেদের পেশাজীবী প্রবাসীদের কাজের সুযোগ করে দেই তাহলে তারা কিন্তু আরও বেশি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নে সহযোগিতা করতে পারবেন। 

রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রভাব পড়বে কিনা সেটা নির্ভর করছে প্রবাসীরা যেসব দেশে কাজ করছেন সেসব দেশে অর্থনৈতিক মন্দা বাড়ছে কি না তার ওপর। যদি মন্দা বেড়ে যায় তাহলে খানিকটা সমস্যা হতেই পারে। সেই সমস্যার বেশ খানিকটা সামাল দেয়া গেছে উন্নত দেশগুলো থেকে বাড়তি রেমিট্যান্স প্রবাহের মাধ্যমে। আমরা প্রবাসীদের বিনিয়োগ করার নানা সুযোগ করে দিচ্ছি। এই বিনিয়োগ করার সুযোগ যদি বজায় থাকে তাহলে খুব বড় সমস্যা হবে বলে আমার কাছে মনে হয় না। 
তবে যারা বিদেশে আছেন তাদের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেয়া উচিত। আমাদের অনেক নারী কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তারা নিরাপদে বিদেশে আছে কি না সেটাও দেখা উচিত। এ ক্ষেত্রে অনেক দু:খজনক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই জায়গাগুলোতে কাজ করার আমাদের অনেক সুযোগ আছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে আমাদের প্রবাস আয় বাড়াতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

বাংলা ইনসাইডার: যদি কোন কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে তাহলে সরকারের কাছে এর কী বিকল্প আছে?


ড.আতিউর রহমান: আমার মনে হয় না সাময়িক এসব কারনে এক্ষুনি রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। সরকার প্রবাসীদের অর্থ পাঠাতে যে সমস্ত উদ্যোগ নিয়েছে এগুলো চালু থাকাতে আমার খুব আশস্কা হচ্ছে না যে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। তবে ভবিষ্যতে যদি কমে যায় তাহলে দেশের অর্থনীতিতে আমরা প্রবাসীদের কার্যকরিভাবে ব্যবহার করবো তেমন পরিকল্পনা থাকা ভালো। তারা কাজ করতে করতে অনেকটাই  স্বপ্রশিক্ষিত হয়ে গেছেন। তাই নতুন করে খুব বেশি প্রশিক্ষন তাদের দিতে হবে বলে মনে হয় না। অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজে নিশ্চয় তাদের কাজে লাগানো যাবে। তাদেরকে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মূল স্রোতে নিয়ে আসতে হবে। 

প্রবাসীদের অর্জিত দক্ষতা আমরা আমাদের স্পেশাল ইকোনমিক জোনে  নিশ্চয় ব্যবহার করতে পারবো। আমাদের অন্যান্য অবকাঠামোগত কাজেও তাদের ব্যবহার করা সম্ভব। তাদের কাজে লাগানোর  মতো ইতিবাচক মানসিকতা আমাদের নীতি নির্ধারকদের এবং উদ্যোক্তাদের অবশ্যই থাকতে হবে। তবেই না দেশটার দ্রুত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭