ইনসাইড টক

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সম্মান নিশ্চিত করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 08/10/2020


Thumbnail

আজ ‘বিশ্ব দৃষ্টি দিবস’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের দৃষ্টি দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে নিরাময়যোগ্য অন্ধত্বকে নির্মূল করার স্লোগান নিয়ে। বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পূর্ণবাসন, চক্ষু চিকিৎসা ও মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডারের নিজম্ব প্রতিবেদক মির্জা মাহমুদ আহমেদ

বাংলা ইনসাইডার: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পূর্ণবাসনে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী: রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ সকল প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।  দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। তাহলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না করে; সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিশেষ শিক্ষক ও বিশেষায়িত শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যাতে দৃষ্টি সম্পন্নদের মতো বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অসমাপ্ত আত্নজীবনীর ব্রেইল সংস্করণের মোড়ক উম্মোচন করেছেন। 
১৯৭৫ এর পর বাঙালি জাতির সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানতে পারেনি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যাতে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্য আরও কিছু বই ব্রেইল সংস্করণে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশসহ পাশ্ববর্তী দেশসমূহে এর আগে কখনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইলে এমন প্রকাশনা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

 যারা চক্ষু চিকিৎসার সাথে যুক্ত তাদের মনে রাখতে হবে; আমরা হয়তো সকলের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারবো না। কিন্তু সকল দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর সম্মানটা যাতে নিশ্চিত হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দৃষ্টি সম্পন্নদের মতো সমান সম্মান সবক্ষেত্রে দিতে  হবে। বার বার বলার পরেও চাকরি ক্ষেত্রে আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারি নাই। এই ব্যাপারে আমাদের আরও সজাগ হতে হবে। 
বেসরকারি খাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। টেলিফোন অপারেটর থেকে শুরু করে অনেক কাজ এখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা অনায়াসে করতে পারেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার ফলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কাজের সুযোগ আরও বেড়েছে।

 আমরা শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি। যে সরকার কি করলো। আমি মনে করি সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা এবং বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগকে সহায়তা প্রদান করা। 
আমরা যারা বেসরকারি খাতের বিভিন্ন পর্যায়ে আছি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে তাদেরকে অগ্রসর হতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকার সহায়তা করবে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল সোসাইটি ফর ব্লাইন্ড (বিএনএসবি) প্রথম এদেশে চক্ষু শিবিরের প্রচলন করে। তাদের দেখাদেখি অনেকেই চক্ষু শিবিরের আয়োজন করে। 
বর্তমানে আগের মতো চক্ষু শিবির না করে; যাদের দৃষ্টিশক্তি ফেরানো সম্ভব তাদের নিয়ে কাজ করা যায়। যাদের চোখে ছানি পড়েছে তাদের নিয়ে কাজ করতে পারে। 
আমাদের দেশে ৮০ শতাংশ অন্ধত্বের কারণ চোখে ছানি পড়া। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় একলক্ষ ২০ হাজার লোক চোখে ছানি পড়ার কারণে অন্ধ হয়। ছানিপড়া রোগীদের অন্ধত্ব থেকে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই দিকে আমাদের আরও বেশি নজর দিতে হবে।

 সরকারি হাসপাতালে চোখের বেডের সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। এছাড়াও গোপালগঞ্জে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নামে একটি চক্ষু হাসপাতাল করা হয়েছে।  দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভিশন সেন্টার স্থাপন করে চক্ষু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে আমাদের অনেক বেশি সচেতনতা প্রয়োজন।  রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সামাজিকভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। 
আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি অন্তত কয়েকজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মনোনয়ন দিয়ে সংসদে সংসদ সদস্য করে আনা প্রয়োজন; যাতে তারা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজের ও সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারে।

যেকোন একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে মন্ত্রী হিসেবেও নিয়োগ করা যেতে পারে। তাহলে তাদের প্রতি একদিকে যেমন সম্মান প্রর্দশন করা হবে অন্যদিকে রাষ্ট্র যে তাদের প্রতি ওয়াকিবহাল সে ব্যাপারে জনগণ, বিশ্ব এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরাও অবহিত হতে পারবে। 

বাংলা ইনসাইডার: চক্ষু চিকিৎসায় বাংলাদেশের অগ্রগতি সম্পর্কে বলুন

সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী: আমি প্রায় ৫০ বছর আগে চক্ষু বিজ্ঞানের একজন চিকিৎসক হিসেবে যখন কর্মজীবন শুরু করি তখন আমাদের জ্ঞানের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিলো। আমরা যখন রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছি সে সময়ের তুলনায় চক্ষু চিকিৎসায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে।

 আমরা আগে একদম অন্ধ ব্যাক্তিদের আংশিক দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা চক্ষু চিকিৎসায় অনেক উন্নত মানের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। আগে যাদের মনে করা হতো একেবারেই দৃষ্টি শক্তি ফেরানো সম্ভব না তারা এখন দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাচ্ছে। বাংলাদেশে চক্ষু চিকিৎসার অনেক উন্নতি ঘটেছে। যেকোন উন্নত দেশের সাথে আমরা তুলনা করতে পারি।

 বাংলাদেশেই এখন আমেরিকান স্টাটার্ডে ছানি ফ্যাকলের চিকিৎসা হচ্ছে। আমাদের ছাত্র ছাত্রীরা আমেরিকার যেকোন সার্জনের চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন নয় বরং বেশি যোগ্য। 
বাংলাদেশে চক্ষু চিকিৎসায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ওপরে অবস্থান করছে। আমরা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গর্ব করতে পারি।

 আমাদের দেশে চিকিৎসক শিক্ষকদের নিয়ে একটি প্রবণতা আছে। 
কোন চিকিৎসক শিক্ষক কতদূর শিক্ষা প্রদান করলেন,কতদূর ট্রেনিং প্রদান করলেন এটা মূল্যায়ন করা হয় না।  তিনি কতটা ভালো চিকিৎসক সেটা মূল্যায়ন করা হয়; তিনি কতটা ভালো শিক্ষক সেটা মূল্যায়ন করা হয়না। আমরা ‘অধ্যাপক’ বলি। ‘অধ্যাপক’ পরবর্তী প্রজন্মকে কতটা শিক্ষিত করেছেন সেটা মূল্যায়নে একটা মেডিক্যাল অডিট হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। 

বাংলা ইনসাইডার: মরণোত্তর চক্ষুদানে জনসাধারণকে কিভাবে উৎসাহিত করা যায়?

সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী: আমাদের দেশে অনেকেই জীবিত থাকা অবস্থায় মরণোত্তর চক্ষু দান করেন। কিন্তু দেখা যায় মারা যাওয়ার পরে মৃত ব্যাক্তির নিকট আত্নীয় স্বজনরা চক্ষু দিতে চান না। 
যত লোক চক্ষু দান করেন সব চোখ আমরা পাই না। অনেকে মরণোত্তর চক্ষু দান করতো উৎসাহিত হচ্ছেন এটা আশার কথা। চক্ষু দান ও অঙ্গ প্রত্যাঙ্গ দানের ব্যাপারে লোকের দৃষ্টিভঙ্গি আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। 
শ্রীলংকা একটা ছোট দেশ কিন্তু ওখানে চক্ষু দানের পরিমাণ আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশি। জনসংখ্যা অনেক বেশি হলেও সেই তুলনায় আমরা চক্ষু দানে পিছিয়ে আছি। 

চক্ষু দানের ব্যাপারে জনসাধারণকে সচেতন করতে চক্ষু বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি গণমাধ্যম এবং সমাজের গণমাণ্য ব্যাক্তিদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। 
রক্তদানের ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা যেভাবে বেড়েছে ঠিক তেমনিভাবে মরণোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে।  

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭