ইনসাইড থট

কোভিড-১৯: বাংলাদেশ এবং এলোমেলো কিছু কথা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/10/2020


Thumbnail

কয়েক সপ্তাহ আগে নামিবিয়ার জাতীয় বেতার কেন্দ্র থেকে আমার কাছে একটি ফোনকল আসে। ওখানে আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কাজ করতাম। বলতে গেলে এ বছর সেখানে কারো কোনো মৌসুমী অসুখ-বিসুখই হয়নি। রেডিও কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমার একটি সাক্ষাৎকার নিতে চাইলো। দক্ষিণ আফ্রিকায় শীতে প্রতি বছর ১০,০০০ এর বেশি মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। কিন্তু এ বছর রোগীর সংখ্যা ছিল খুব অল্প। অস্ট্রেলিয়ায় মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। গত বছর সেখানে ৩ লাখ  দশ হাজার রোগী শনাক্ত হয়, আর মারা যায় ৪৩০ জন।

ন্যাশনাল নটিফিয়েবল ডিজিস সারভেইল্যান্স সিস্টেম জানিয়েছে  এ বছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে ৩৬ জন মারা গেছে। বিজ্ঞানীরা এটা দেখে হতবাক। তারা মৃত্যুহার এতটা কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, মাস্কের ব্যবহার বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, এবং ভ্যাক্সিনের ব্যবহার বাড়ানোর কারণে কি মৌসুমী ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার হার কমেছে ? হতেও পারে।

বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ ও ডাক্তাররা আসন্ন শীতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে পারে ভেবে চিন্তিত। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে বলেছেন। এটা খুবই ভাল লক্ষণ। আমি সাক্ষাৎকারে নামিবিয়ার সরকারকে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে যেকোনো জরুরী অবস্থার মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছি। 

ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। যুক্তরাজ্য, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতলে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সেখানকার হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ফ্রান্সের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকর্মী সেবা দিতে দিতে ক্লান্ত। নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগ এবং ঠিকমতো দেখভাল করায় মৃত্যুহার আগের চেয়ে কমেছে। যুক্তরাজ্য এখনও করোনা শনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশটির দীর্ঘদিনের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় ?

অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে কথা বলছেন। আমাদের এখানে কি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে, না এখনও প্রথম ঢেউই চলছে, নাকি প্রথম ঢেউয়ের সাথেই দ্বিতীয় ঢেউ মিশে গেছে ? যা-ই ঘটুক, ১০-১২ শতাংশ আক্রান্তের হার সংক্রমণের ব্যাপকতাকে ইঙ্গিত করে। অতিরিক্ত জনসমাগম, অফিসে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অপর্যাপ্ততা, সামাজিক দূরত্ব মেনে না চলা, এবং ঘরের বাইরে মাস্কে ব্যবহার না করায় সংক্রমণের হার কমছে না।

করোনায় সংক্রমণের ফলে তেমন জটিলতা না হওয়ায় এবং মৃত্যুহার কম থাকায় মানুষের করোনা নিয়ে উদ্বেগ কমেছে। এর চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হওয়ায় অনেকে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে। আমি নিশ্চিত তরুণ এবং অল্পবয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উপসর্গবিহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত সংক্রমণের হার উচ্চ থাকায় তা ব্যাপক মাত্রায় কমিউনিটি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।

র‍্যান্ডমাইজড এন্টিবডি টেস্টের ফলাফল থেকে জানা গেছে, ঢাকার ৪৫ শতাংশ মানুষ এবং ৭৫ ভাগ বস্তিবাসী ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৪৫ ভাগেরই কোনো উপসর্গ ছিল না। বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকাগুলো কি হার্ড ইমিউনিটির দিকে আগাচ্ছে, নাকি ইতোমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে?

জনগণের দেশজুড়ে অবাধ যাতায়াতে গ্রামের মানুষও হার্ড ইমিউনিটির দিকে আগাতে পারে। এ খবরে খুশি হওয়ার কিছু নেই। সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা, এবং হাত ধোয়ার মত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পাশাপাশি রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও এনজিওগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা এসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে কোভিড-১৯ এবং আসন্ন শীতের মৌসুমী রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারব।

এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে কিছু বলি

১.

আমার এক বন্ধুর ছেলের স্ত্রী সন্তানসম্ভাবা। সে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস পার করছে। কিছুদিন আগে সে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হওয়ায় চিন্তিত ছিল। তার স্বামী পরামর্শের জন্য কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও কোনো চিকিৎসা পায়নি। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় কোনো হাসপাতালই তাকে ভর্তি করতে চায়নি। শেষমেশ তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটি প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ হয়। আল্ট্রাসনোগ্রামসহ প্রয়োজনীয় সব টেস্টের রিপোর্ট স্বাভাবিক আসায় তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য কিছুদিন হাসপাতালে রাখা হয়েছিল।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মার্চে লকডাউনের শুরু থেকেই বাসা থেকে কাজ করতো এবং কেনাকাটাও করতো অনলাইনে। সে কোভিড-১৯ আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে আসেনি, আর তার কোনো উপসর্গও ছিল না। এরপরও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার করোনা টেস্টের রিপোর্ট ছাড়া তার স্ত্রীকে চেকআপ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় দুজনেই টাকা খরচ করে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য রাজি হয়। কাউকে সেবা দিতে অস্বীকৃতি না জানানোর ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।

একবার ভাবুনতো যে মহিলার পয়সা খরচ করে করোনার টেস্ট করানোর সামর্থ্য নেই, ফ্রিতে টেস্ট করানোরও সুযোগ নেই, সে যদি গর্ভাবস্থায় কোনো মারাত্মক জটিলতায় পড়ে সেবা না পায় তার কি হবে। সে কিংবা তার অনাগত বাচ্চা চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে পারে। অনেক দেশেই দেখা যায় সন্তানসম্ভাবা মহিলারা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে হাসপাতালে যান না। আবার হাসপাতালে গেলেও ডাক্তার, নার্সরা করোনার ভয়ে তাদের কাছে ঘেঁষে না। যুক্তরাজ্যে ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং  হার্টের অসুখে আক্রান্ত অনেক রোগীই হাসপাতালে যায় না।

ধারণা করা হচ্ছে, এ কঠিন সময়ে বিশ্বজুড়ে প্রসূতি এবং নবজাতকের মৃত্যু আগের চেয়ে বাড়তে পারে। মা ও নবজাতকের জীবন বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে কেউ যেন মাতৃত্বকালীন সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার ও নার্সদের এ সংক্রান্ত সকল নির্দেশনা জানানোর দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। স্বাস্থকর্মীদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা এবং অনিচ্ছার কারণে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেয়ার মাধ্যমে স্বাথ্যখাতে অর্জিত সফলতাগুলো আমরা ধূলায় মিলিয়ে যেতে দিতে পারি না। স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা দেয়ার সময় যাতে করোনায় আক্রান্ত না হয় সে দিকটি নিশ্চিত করার জন্য স্বাথ্য মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে।

২.

জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদরদপ্তরে নিরাপদ গর্ভধারণ (মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য) নিশ্চিতকরণ নামে একটি বিভাগের পরিচালক থাকাকালীন আমাকে সপ্তাহব্যাপি একটি মিডিয়া ট্রেনিং-এ যেতে হয়েছিল। ক্যামেরা অন করে শুরুতেই প্রশিক্ষক আমাকে বিশ্বজুড়ে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছিল। প্রসূতি ও নবজাতকের উচ্চ মৃত্যুহার, সাফল্য, ব্যর্থতা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করার ব্যাপারে আমার বিভাগের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।  

এরপর তারা আমাকে বাসায় গিয়ে ভিডিওটি দেখতে বলে যাতে আমি নিজের বক্তব্যের ভালো-মন্দ বিচার করে পরদিন আবার প্রস্তুত হয়ে আসতে পারি। নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে গণমাধ্যমের আধুনীকায়ন ঘটেছে এবং জনগণেরও বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞান আগের চেয়ে বেড়েছে। আমাদের মন্ত্রী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের গণমাধ্যমের সামনে কথা বলা দেখে আমি হতবাক। যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমের সামনে কথা বলা বন্ধ করতেন তাহলে কতই না ভালো হত!

বাংলাদেশের জনগণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মত চিকিৎসা পাচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্য পড়ে আমি হাসি থামাতে পারিনি। বাংলাদেশের কাছে রিজেনারন্সের মনোক্লোনাল এন্টিবডি ড্রাগআছে কিনা আমার জানা নেই। গবেষণার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১০ জনের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। আর ট্রাম্প তাদের মধ্যে একজন। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স পাওয়ার আগেই প্রেসিডেন্ট পদাধিকারবলে তিনি ওষুধটি নিয়েছেন। এছাড়াও মন্ত্রী হাসির খোরাক যোগানোর মত অনেক কথাই বলেছেন। তার অসংলগ্ন কথাবার্তা সরকারের অর্জন এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বকে ম্লান করেছে। সব মন্ত্রী এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তারই কিভাবে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া প্রয়োজন। আর না হয় তারা কথা কম বলুক বা চুপ থাকুক।

৩.

এইচএসসি পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের সনদ দেয়ার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ফেসবুক হাস্যরসাত্মক ভিডিও ও ট্রোলে সয়লাব। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হতে বলেছিল তারা। এর ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়ে তাদের হোস্টেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে শুরু করে। শুধু তাদের বাবা-মাকেই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে গেটের সামনে রেখে আসার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। অনেক শিক্ষার্থীকে বড়দিন না আসা পর্যন্ত সেখানে থাকতে হতে পারে। যেখানে অনলাইন ক্লাসেই পাঠদান করানো হচ্ছে সেখানে কেন তাদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার কথা বলা হলো এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে। এটা কি সত্যিই ছাত্রছাত্রীদের ভালোর জন্যে করা হয়েছিল, না কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টিউশন ফি এর ব্যাপারে আইনি জটিলতা এড়াতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?

যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের নাগরিকরা তাদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশুনার জন্য বছরে প্রায় ১১ হাজার ইউরো খরচ করে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের এর দ্বিগুণ টাকা পরিশোধ করতে হয়। যুক্তরাজ্যের এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরকে আমি শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে অনলাইন ক্লাস করানোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিকে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন, আর সেজন্যই তারা এটা করছে।

আমরা কি খেয়াল করেছি যুক্তরাজ্য সরকার পরীক্ষা নেয়া ছাড়াই শিক্ষকদের আগের মূল্যায়ণের ওপর ভিত্তি করে জিসিএসই এবং অন্য সনদগুলো শিক্ষার্থীদের প্রদান করেছে ?  আমি মনে করি বাংলাদেশের পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক। প্রায় ২৬ লক্ষ শিক্ষার্থীকে বদ্ধ ছোট ক্লাসরুমে বসিয়ে এ সংকটের সময় দিনের পর দিন পরীক্ষা নেয়ার কোনো মানেই হয় না। আমরা এ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে পারি, তবে সেইসাথে আমাদের অবশ্যই এর বিকল্প একটি উপায় সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করার দরকার আছে।

৪.

ধর্ষণ সব সমাজেই ঘৃণিত একটি অপরাধ। আমাদের সবাইকেই এর নিন্দা করতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। দিনের পর দিন ধরে এমন হতে দেয়া যায় না। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সমাজকে ধর্ষণ বন্ধে আরো কঠোর হতে হবে। এ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে এবং সরকার ও সমাজের টনক নড়াতে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে এবং অনশন কর্মসূচি পালন করছে। এগুলো শুভ লক্ষণ। রাজনোইতিক উদ্দেশ্যে কিছু অসাধু রাজনীতিবিদের এ বিষয়টির অপব্যবহার আমাকে ব্যথিত করেছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরির মত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ধর্ষণের ইস্যুর সাথে অন্য বিষয়গুলো মিলিয়ে বর্তমান সরকারকে উৎখাতের সুযোগ খোঁজা সত্যিই দুঃখজনক।

কয়েকজন নারীর প্ল্যাকার্ডে ‘আমরা ধর্ষিতা হতে প্রস্তুত’ এমন অশালীন বাক্য লিখে সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দেয়া আমাকে ব্যথিত করেছে। কয়েকজন মন্ত্রী দেশের ধর্ষণের কারণ হিসেবে পর্নোগ্রাফিকে দায়ী করেছেন। তাদের এমন অসংবেদনশীল আচরণে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি। আমি তাদের অনুদ্রোধ করছি, দয়া করে ধর্ষণের মত ঘৃণিত অপরাধ নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা না বলে এবার থামুন। আপনার পরিবারের নারী সদস্যদের কথা ভেবে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের ধর্ষণের মামলা নিতে অনীহা এবং ধর্ষককে গ্রপ্তার করার পরও ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন দেয়ার প্রবণতা আমাকে খুব পীড়া দেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় থাকাকালে আমরা বিভিন্ন দেশে যৌন হয়রানির কারণগুলো নিয়ে গবেষণা করতাম। আমরা দেখতাম বেশিরভাগ ঘটনায়ই মেয়েরা তাদের খুব কাছের আত্মীয় দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। সামাজিক ও সংস্কৃতিগত কারণে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও পরিবারের লজ্জার কথা ভেবে অনেক মেয়ে এবং তাদের পিতামাতা এ বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা না বলে গোপন রাখেন। এ কারণে আমরা ঘটনার প্রকৃত মাত্রা জানতে পারি না। কোনো মেয়ে বা তার বাবা-মা এ বনিয়ে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসলে  আমাদের অবশ্যই বিষয়টিকে সংবেদনশীলভাবে দেখতে হবে। এটা সহজ কোনো কাজ নয়। এর জন্য অনেক সাহসের প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই তাদের পাশে থাকা উচিৎ। প্রধানমন্ত্রী নারীর সম্মান রক্ষায় ও ক্ষমতায়নে কতটা সচেষ্ট তা আমি জানি। হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য কেউ যেন তা লুণ্ঠন করতে না পারে তা নিশ্চিতে এবং ধর্ষণ বন্ধে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।

প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. হকের লেখা একটি প্রবন্ধ আমি পড়েছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মরত থাকাকালীন আমি তাঁর সাথে কাজ করেছি এবং তাঁকে খুব ভালো করেই চিনি। তিনি খুব ভালো একজন মানুষ। তাঁর সাথে কাজ করে আনন্দ পেয়েছি। রুহুল হোক তাঁর প্রবন্ধটিতে বেশি বেশি করোনা টেস্টের কথা বলেছেন। বাংলাদেশে অধিক হারে করোনা টেস্ট করানোর প্রয়োজনীয়তার কথা আমি নানা জনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে শুনেছি। পিসিআর টেস্ট ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য এন্টিজেন টেস্ট পিসিআর টেস্টের মত নির্ভুল না হলেও বেশ নির্ভরযোগ্য। এ পরীক্ষা অল্প সময়ে যেকোনো জায়গায়ই করা যায়। খরচও খুব বেশি না। সম্প্রতি গ্রীসের নতুন শরণার্থী শিবিরগুলোতে অল্প কয়েকদিনে কয়েক হাজার করোনা টেস্ট করা হয়েছে। এর ফলাফলও পাওয়া গেছে মাত্র ৩০ মিনিটে।

এন্টিবডি টেস্ট সংক্রমণের মাত্রা বোঝার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। এ পদ্ধতিতে কোন শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত তা সহজেই বের করা যাবে। এর মাধ্যমে নীতিনির্ধারকরা যথোপযূক্ত ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আমি আগেই বলেছিলাম কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং আইসোলেশন সুবিধা নিশ্চিত না করতে পারলে শুধু করোনা টেস্ট বাংলাদেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, দুর্ভোগ এবং মৃত্যুহার কমাতে পারবে না। ভারতেও প্রতিদিন হাজার হাজার পরীক্ষা করে একই কারণে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি সংক্রমণ কমানো যায়নি। এমন সুযোগ সুবিধা পর্যপ্ত পরিমাণে না থাকায় অথবা অধিকাংশ জনগণ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় তা করা সম্ভব হচ্ছে না। কোভীড-১৯ এর সংক্রমণ হ্রাস ও মৃত্যুহার কমানো এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন ও ক্ষুধা দূরীকরণে বাংলাদেশের একটি ভারসাম্যপূর্ন কৌশল প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে ভালোভাবে অবগত আছেন এবং তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭