ইনসাইড আর্টিকেল

ছুটির দিনে বই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/10/2020


Thumbnail

গত কয়েকদিন কোন লেখালেখি হচ্ছে না। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলী হয়ে আসা,নতুন কর্মস্থল, নতুন পরিবেশ,পরিবারের সদস্যদের সান্নিধ্যে থাকা ইত্যাদি নানা কারণে হয়ে উঠে নি।

দু’দিন পূর্বে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত অন্যতম প্রধান ও আলোচিত সাপ্তাহিক ‘ত্রকুশে’ পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার অনেকটা আক্ষেপ করেই জানালেন, বিগত দু’বছরের বেশি সময়ে উল্লিখিত সাপ্তাহিকের কোন সংখ্যা নাকি আমার লেখা ছাড়া বের হয়নি। কেবল বর্তমান সংখ্যাটিই ব্যতিক্রম। শুনে আমি যতটা না কষ্ট পেয়েছি এর চেয়ে অধিক অনুপ্রাণিত ও উচ্ছ্বসিত হয়েছি। ভাবছি, আমার ক্ষুদ্র পরিসরের এ লেখাগুলোরও হয়তো পাঠক মহলে কদর আছে।

হাইস্কুলের ছাত্রাবস্থায় গ্রামের বাড়িতে একটি পুরনো ইংরেজি অভিধান বা dictionary পেয়েছিলাম। জানা যায়, পঞ্চাশের দশকের শেষের দিক থেকেই আমাদের পূর্বসূরিগন এটি ব্যবহার করে এসেছেন। আমি প্রথম যখন মালিক হই তখনও এর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। শরীরের নানা স্থানে বার্ধক্যের স্পষ্ট ছায়া। একাধিক প্রজন্মের অসংখ্য হাতের স্পর্শে মলিন এবং বিবর্ণ সে। প্রায় প্রতি পৃষ্ঠার কোনায় জমেছে কালো ছাপ। কভারের বাঁধাই করা মলাটটি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে দেহের সাথেই ঝুলে আছে। অযত্নে-অবহেলায় দাদীর ঘরের ফুলচাংগের ময়লা কাগজ পত্রের সাথে এর বসবাস ছিল। একে সম্পূর্ণ গুরুত্ব দেয়ার মতো অবশিষ্ট কোন ছাত্র তখন আর কেউ ছিল না। অতীতে একে প্রতিদিন স্পর্শ করতো, চোখের সামনে রাখতো বা মর্যাদা দিত তারা অর্থাৎ আমার বাবা বা চাচারা সে সময় কর্মস্থলে প্রবেশ করে সবাই সংসারে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এর দিকে ফিরে তাকানোর তেমন কোন অবকাশ ছিল না। যেন এটি মূল্যহীন, অপ্রয়োজনীয় কেবল কালো হরফে ছাপানো এক আবর্জনায় পরিণত হতে যাচ্ছে। ঠিক তখনই সে নিজে থেকে আমাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। আমিও যেন প্রথম দর্শনে এর প্রেমে পড়ে যাই। যখনই নতুন কিছু চোখে পড়ে অমনিতেই কালবিলম্ব না করে ওর স্মরণাপন্ন হলে দ্রুত সমাধান।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আমি হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়েই কতিপয় ভাল ছাত্র ও শিক্ষকের নিকট থেকে dictionary বিষয়ে বা এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা-বার্তা শুনি। তখন থেকেই ভাবতে থাকি, আমাকেও একখানা dictionary কিনে নিতে হবে। আশ্চর্য ! শিক্ষাজীবনের এমন প্রস্ত্তুতিলগ্নে সে যেন স্বত:প্রনোদিত হয়ে আমার হাতের নাগালে এসে আশ্রয় নেয়। আমি তাকে প্রথমবার কাছে পেয়েই একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যাচ্ছি আর দেখছি ভেতরে অসংখ্য স্থানে নানা কালির ছোঁয়ায় প্রচলিত সকল তাৎপর্যপূর্ণ শব্দমালার গায়ে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা আছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, প্রথমে এ শব্দগুলোর অর্থ মুখস্হ করতে থাকবো। পরে অন্য কিছু। সেদিনই আমি একে গামছা দিয়ে মুছে গায়ের ধুলাবালি পরিস্কার পূর্বক সযত্নে আমার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পড়ার টেবিলে প্রতিস্থাপন করি। যা প্রায় পাঁচ দশক অতিক্রম করে আজো আমার হাতের মুঠোয় সঞ্চিত আছে।

হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল গন্ডি পেরিয়ে ব্যক্তিগত কর্মজীবনে প্রবেশের পরও আমার অন্যসব পৈত্রিক সম্পত্তির মত প্রাপ্ত এ, টি, দেব এর এই dictionary টির দিকে সম্প্রতি পুনরায় নজর দিলাম। এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে একে অতি সাবধানে ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত পুরাতন বই বাঁধাইয়ের দোকানে নিয়ে যাই। দোকানির সাথে আলোচনার পর, এর লালছে রঙ্গের প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলোর তিনদিকেই ধারালো কাঁচি চালায় সে। আমার অতিসতর্কতা আর গুরুত্ব প্রদানের ভাব দেখে সে নিজেও বিস্মিত এবং বাকরুদ্ধ হয়। তার অবস্থা অনেকটা আপারেশন থিয়েটারে জীবন্ত মানুষের শরীরে একজন অভিজ্ঞ সার্জন যেভাবে ছুরি চালান প্রায় সেরকম। বেশ কয়েক মিনিটের সফল অস্ত্রোপচারের পর আমার প্রিয় অভিধানটিকে যথারীতি পূর্ণবিশ্রামের উদ্দেশ্যে আজিমপুরের সরকারি বাসায় নিয়ে আসি।

মনে পড়ে, স্কুল ফাইনাল বা এস, এস,সি পরীক্ষার পূর্বে নবম বা দশম শ্রেনীতে থাকার সময়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের ইংরেজির শিক্ষক অনিল স্যারকে ঠেকানোর জন্য অভিধান থেকে সবচেয়ে কঠিন ও বিরল (uncommon) শব্দ বের করে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে রাখতাম। স্যার যথারীতি ক্লাসে প্রবেশ করেই শব্দটির দিকে তাকাতেন। খানিক পরে তিনি হাসতে হাসতে পাশে এর বাংলাটি লিখে দিতেন। সে সময় আমাদের বিস্ময়ের কোন সীমা থাকতো না। তখন আমরা সবাই জানতাম, স্যার এ, টি দেব এর dictionary টি মুখস্হ করেছেন। আহ ! আমাদের সময়ের শিক্ষক।

এতক্ষণ এ,টি, দেব এর একটি dictionary বা ইংরেজি অভিধানের কথা বলেছি। এ,টি, দেব এর পুরো নাম আশুতোষ দেব মজুমদার। আমাদের সময় পর্যন্ত dictionary বলতে সকলেই A. T. DEV কেই জানতো। এর বেশি কিছু নয়। আজকাল আমাদের হরেকরকম ইংরেজি, বাংলা, Oxford Advanced Learner’s, Samsad Bengali, English dictionary, Modern language dictionary রয়েছে। তবু এ, টি, দেব যেন দুরন্ত কৈশোর পার হওয়া আমাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এর যেন কোন তুলনা নেই। এখন আমার সন্তানদের হাতে থাকা ছোট বড় নানা বহনযোগ্য (portable) dictionary থাকলেও আমি সেই আদি ও অকৃত্রিম এ, টি, দেব বাবু’র উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আছি। তবে একটি কথা বলে রাখা ভালো, এ, টি, দেব বাবু যে কখনো ইংরেজি সাহিত্য পড়েন নি, এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্র ছিলেন না তা জেনেছি মাত্র ক’বছর পূর্বে।

আশুতোষ দেব ১৮৬৬ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বরদাপ্রসাদ দেব মঞ্জুমদার। বাবা একজন বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশক এবং একাধিক প্রেসের মালিক ছিলেন। একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর সন্তান আশুতোষ কলকাতার এলবার্ট স্কুল থেকে এনট্রান্স পাস করে ডাক্তার হওয়ার লক্ষে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু মাঝ পথে এসে তিনি ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে বাবার প্রেসের ব্যবসায় যোগ দেন এবং শক্তহাতে এর হাল ধরেন। জানা যায়, আশুতোষ আর কোন প্রাতিষ্ঠানিক লেখা পড়া করেন নি। ভবিষ্যতে তার হাতেই গড়ে উঠে স্বনামধন্য এ.টি.দেব প্রেস। আশুতোষের সবচেয়ে বড় অবদান হলো-অভিধান এবং dictionary সৃষ্টি। তিনি ইংরেজি থেকে বাংলা, বাংলা থেকে ইংরেজি এবং বাংলা থেকে বাংলা নানাবিধ অভিধান রচনা করেছেন। বলা হয়ে থাকে, বাঙালিরা কখনো এত নির্ভুল, এত সহজলভ্য অভিধানের কথা পূর্বে কল্পনাও করেন নি। Students Favourite dictionary, শব্দবোধ-অভিধান সবই তাঁর অভিনব ও অনবদ্য সৃষ্টি।

আমাদের অতি পরিচিত সেই এ.টি. দেব বাবু বৃটিশ আমলেই অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অসাধারণ কীর্তি তাঁকে আজো বাঁচিয়ে রেখেছে বাঙালির ঘরে ঘরে, বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭