ইনসাইড আর্টিকেল

`জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ`

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/10/2020


Thumbnail

৩ এপ্রিল ১৯৭১, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এমনটি  "Action against miscreants at Jinjira"। অর্থাৎ "জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ"। আর তৎকালীন পিটিভি অর্থাৎ পাকিস্তান টেলিভিশন ঐ দিন ২ এপ্রিল রাতে সংবাদ প্রচার করে, " বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে"।

 আর এই একই ঘটনায় কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রত্যক্ষদর্শনে  বর্ণনাটি এমন-  

“একটি ডোবার ভেতরে মাথা গুঁজে বসে আমি তখন এমন একটি করুণ মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি যা আমি কোনদিন ভুলে যেতে পারবো না। পারি নি। আমি দেখি, শেলের আঘাতে একজন ধাবমান মানুষের দেহ থেকে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে আমি যে ডোবায় লুকিয়ে ছিলাম সেই ডোবার জলে, কিন্তু ঐ মানুষটি তারপরও দৌড়াচ্ছে। শেলের আঘাতে তার মাথাটি যে দেহ থেকে উড়ে গেছে, সেদিকে তার খেয়ালই নেই। মস্তকছিন্ন দেহটিকে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর লোকটা আর পারলো না, তার কবন্ধ দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। মস্তকহীন দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তস্রোতে ভিজে গেল শুভাড্যার মাটি।"

মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক কালে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট এর পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার পর ঢাকা নগরীর বেঁচে যাওয়া মানুষজন পালানোর স্থান ও প্রথম নিরাপদ আশ্রয়স্থল রূপে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত জিঞ্জিরার দিকে যাত্রা করে। জিঞ্জিরা ও এর আশেপাশের অঞ্চলগুলো ছিল তখন প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। তাই সেগুলো আগে থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক চিহ্নিত ছিল। যখন ঢাকা থেকে পালিয়ে সবাই সেখানে একত্র হতে থাকে, তখন পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নেয়।  তারা ১ এপ্রিল মধ্যরাতের পর থেকে অর্থাৎ ২ এপ্রিল ভোর থেকে জিঞ্জিরায় সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে এবং কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। 

নৃশংস গণহত্যাটি শুরু হয় শুক্রবার ভোর রাতে। এই বারটি বেছে নেওয়ার একটি বিশ্লেষণ পাওয়া যায় নির্মলেন্দু গুণের “আত্নকথা ১৯৭১’ বইয়ে। গুণ লিখেছেন সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্টের নীতিনির্ধারকরা যুদ্ধে নিয়োজিত সকল পাকসেনাদের ধারণা দিয়েছিল যে যাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ তারা সবাই মালাউন, ভারতের চর। এই ভারতের চররা ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু। তাই এইসব মালাউনদের হত্যা করা জন্য শুক্রবারই ভাল দিন।

পাকিস্তানরা ঐদিন গভীর রাতেই বুড়িগঙ্গার অন্য পাড়ের মিটফোর্ড হাসপাতাল অধিকার করে এবং চিকিৎসালয় সংলগ্ন মসজিদের ছাদ থেকে আনুমানিক ভোর ৫টায় ফ্লেয়ার ছুড়ে গণহত্যা আরম্ভ করার জন্য সংকেত প্রদান করে। আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫ টা থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে একটানা নয় ঘণ্টা চালিয়ে যায় এবং দুপুর ২.৩০ এ হত্যাযজ্ঞ শেষ করে। তারা ঘরবাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে,  পাকিস্তানি বাহিনী ষাট জন লোককে একসাথে একই সারিতে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। 

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নরঘাতক পাকসেনাদের দ্বারা বিভিন্ন পরিকল্পিত গণহত্যা পরিচালিত হয়েছে। একাত্তরের এইসব গণহত্যাগুলো বিংশ শতাব্দির কুখ্যাত ইহুদীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ভিয়েতনামে মার্কিনের দ্বারা গণহত্যা কিংবা রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পাকসেনারা যে কত হিংস্র হয়ে বাংলার স্বাধীনতাকামী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে তা একজন পাকসেনার স্বীকার উক্তি থেকে পাওয়া যায়। 

we were told to kill hindus and kafirs (non-believers in God). One day in June, we cordoned a village and were ordered to kill the kafirs in that area. We found all the women reciting from the Holy Quran and the men holding special congregational prayers seeking God’s mercy. But they were unlucky. Our commanding officer ordered us not to waste any time” (confession of a pakistani soldier )

 এ গণহত্যায় আনুমানিক সহস্র বা তার চেয়ে অধিক সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। দৈনিক বাংলা,৩ এপ্রিল ১৭৭২ সুত্রমতে এই হত্যাযজ্ঞটি পরিচালনা করে কুখ্যাত পাক ব্রিগেডিয়ার রশিদ।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭