কালার ইনসাইড

ঊনপঞ্চাশ বাতাস : আমাদের নগ্ন পশ্চাৎদেশীয় সিনেমা ডিস্ট্রিবিউশন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/10/2020


Thumbnail

আপনার কি মনে আছে শেষ কবে এদেশের প্রায় সব শ্রেনীর দর্শক সিনেমা উন্মাদনায় মেতেছিলো? অথবা শেষ কবে একটা দেশীয় মানসম্পন্ন সিনেমা নিয়ে সিনেমা হলের গলি থেকে রাস্তার ধারের গলির মোড়ের টং দোকানের প্রজন্ম মেতেছিলো সিনেমা আলোচনায়! হয়তো পেয়ে যাবেন দুই তিনটি সিনেমার খুব ছোট একটা নামের লিস্ট।

হ্যা আপনার মাথায় হয়তো চলে আসবে “আয়নাবাজী”, “ঢাকা অ্যাটাক”, “দহন”, “ডুব” কিংবা “দেবী” সিনেমাগুলোর নাম। কিন্তু কখনো কি আপনার ভাবনায় এসেছে এসব আলোচিত সিনেমাগুলোর প্রয়োজক বা লগ্নীকারী কতোটা লাভের মুখ দেখেছিলেন অথবা কেনো বছরের পর পছর পেরিয়ে গেলেও দর্শকের চোখে সফল সিনেমাগুলোর পরিচালকদের পরবর্তী সিনেমা কেন আসছে না।

একটা সময় বাংলা সিনেমার জন্য স্বর্ণযুগ ছিলো। সারাদেশব্যাপী ছিলো প্রায় ১২০০ এর অধিক সিনেমাহল। সারাবছর প্রচুর মানসম্পন্ন সিনেমা নির্মাণের পাশাপাশি সিনেমা হল মালিকেরাও ছিলেন লাভবান। প্রায় দুই তিন দশক আগেও বাংলা সিনেমাতে ছিলোনা বুকিং এজেন্ট নামক টার্মটি। সেই সময়টাতে প্রায় প্রতিটি হল মালিকের সাথে পেশাদার প্রয়োজক, পরিচালক, নায়ক-নায়িকাদের ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। পরবর্তী সময়ে ওই সকল হল মালিকদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিরা হয়তো সেই সুসম্পর্ক ধরে রাখা বা টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই উদাসীন ছিলেন। এ সময়টায় অনেক হল মালিক তার হলটি পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার কর্মচারী বা তৃতীয় কোনো পক্ষকে। এদের হাত ধরেই জন্ম হয় বাংলা সিনেমার দালাল চক্র বা বুকিং এজেন্ট নানধারী কিছু মুখোশ মানুষের। বুকিং এজেন্ট নামধারী এসব দালাল চক্রের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে বিশেষ বিশেষ নায়ক নায়িকা এবং পরিচালকদের। সুবিধা হিসাবে বুকিং এজেন্টরা ওই তারকা বা পরিচালকের সিনেমা ছাড়া নতুন কোনো মুখ বা পরিচালকের সিনেমাকে হলে প্রদর্শনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাঁধা দিতে থাকেন। জিম্মি হয়ে পড়ে এদেশীয় সিনেমা। ফলাফলে একটি ভালো গল্প বা নতুন কোনো অসাধারণ অভিনেতার অভিনীত সিনেমা খেতাব পেতে শুরু করে ফ্লপ কিংবা লোকসান ট্যাগের।

বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্রের ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে ই-টিকেটিং না থাকায় কোনো সিনেমা দর্শক টানলেও সেই সিনেমার প্রযোজক সঠিকভাবে জানেন না মুক্তি পাওয়া হলগুলো থেকে একটি নির্দিষ্ট সিনেমা হলে কোনো একটি শো তে কতজন দর্শক টিকেট কেটে তার সিনেমাটি দেখেছে। ঢাকার বাইরের সিনেমা হলগুলোতে যদি ফিফটি ফিফটি শেয়ারে একজন হল মালিকের কাছে কোনো সিনেমা ভাড়া দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে যে টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়েছিলো তার থেকে যদি  সিনেমার টিকেট থেকে আরো বেশি আয় হয় সেটির অর্ধেক পাবার কথা প্রয়োজকের। কিন্তু এই জায়গাটিতে বুকিং এজেন্ট, পরিবেশন সংস্থার ম্যানেজার এবং হল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কারসাজিতে সিনেমাটির সেল অর্ধেক দেখান। প্রয়োজক এখানে থেকে যায় অন্ধকারে, কারণ ই-টিকেটিং না থাকায় এবং টিকেট বিক্রির সঠিক হিসাবের জন্য হল রিপ্রেজেন্টেটিভ এর উপর নির্ভর করায় তিনি তার সিনেমার দর্শকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত টাকার সঠিক হিসাব পাচ্ছেন না। যদি একটি সিনেমার একদিনের আয় হয় ৭০ হাজার টাকা হল মালিকের যোগসাজশেই সেটি কমিয়ে জানানো হয় ৩০ হাজার টাকা। এখানে দালাল শ্রেনী মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভের আশায় সেল দেখাবেন অর্ধেক। প্রয়োজক খালি চোখে যদিওবা দেখেন তার সিনেমা হাউজফুল কিন্তু হিসাবের খাতায় তিনি শূন্য। অবাক করার বিষয় হচ্ছে সিনেমা হলগুলোর বেশিরভাগেই প্রজেক্টর খরচের টাকাটিও দিতে হয় সিনেমার প্রযোজককে, সেই সাথে যোগ হয় আরো অনেক অজ্ঞাত খরচের হিসাব।

ঢাকার বাইরের জেলা শহরের সিনেমা হলগুলোতে আবার আরো এক ধরণের হিসাবও চলমান আছে। এখানে ১০০ টাকা টিকেটের একটি সিনেমা থেকে লভ্যাংশ থেকে প্রয়োজক পান ১৬ টাকার মতো। উপজেলা পর্যায়ের সিনেমা হলগুলোতে এই সংখ্যা আরো কম (৫০ টাকার টিকেটে অনধিক ৮-৯ টাকা)। এখন দেশীয় সিনেমার বেহাল দশার জন্য যদি ভালো গল্প আর ভালো নির্মানকে দায়ী করে থাকেন তাহলে পকেটের টাকা লগ্নী করে ভালো সিনেমা বানিয়ে লোকসান দেবার মতো দাতা হাতেম নিশ্চয়ই কেউ নন। হিসাব হয়তো এবার কিছুটা মিলছে প্রথমেই করা প্রশ্নগুলোর!

বাংলাদেশে স্মার্ট আর সকল রকমের সুবিধা সম্পন্ন মাল্টিপ্লেক্স আছে স্টার সিনেপ্লেক্স এবং যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার। বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্স থেকে টিকেট প্রতি প্রয়োজক পেয়ে থাকেন ৯০ টাকার মতো। এসব মাল্টিপ্লেক্স রয়েছে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত ই-টিকেটিং ব্যবস্থা এবং দর্শকদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ।  

করোনা চলাকালীন সময়ে বন্ধ ছিলো দেশের সবগুলো সিনেমা হল। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থেকে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত ১৬ অক্টোবর খুলে দেওয়া হয়েছে দেশের সিনেমা হলগুলো। সরকার সিনেমা হলগুলো রক্ষায় প্রণোদনা হিসাবে বরাদ্দ করেছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশাল পরিমাণ বরাদ্দ থেকে আদৌ কি বাংলা সিনেমার কোনো রকমের উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে? সিনেমা হলগুলোর সংস্কার আর বাঁচিয়ে রাখতে দেয়া প্রণোদনার টাকাগুলো হয়তো হল মালিকেরা ঠিকই নেবেন কিন্তু হবেনা সিনেমা হলের কোনো রকমের উন্নতি। হয়তো পরিবর্তিত হবে না মান্ধাতার আমলের টিকেটিং ব্যাবস্থারও। ধীরে ধীরে লোকসানের পড়ে লোকসান গুণতে থাকা প্রযোজকেরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন বাংলা সিনেমা থেকে।

এই ১ হাজার কোটি টাকা থেকে কিছু পরিমাণ টাকার বিনিময়ে জেলা শহরগুলোর সরকারী খাস জমিতে যদি করা হয় মাল্টিপ্লেক্স এবং যদি থাকে স্বচ্ছ বিপনন ব্যাবস্থার সাথে সাথে সঠিক ই-টিকেটিং তাহলেই সম্ভব বছরে অনেক অনেক ভালো সিনেমা নির্মাণ এবং তাহলেই হয়তো সম্ভব হবে প্রযোজকের লগ্নী করা টাকা লাভ সহ তার পকেটে পৌঁছে দেওয়া।

নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল দর্শকের কাছে আগে থেকেই সুপরিচিত তার বৈচিত্রময় গল্প এবং স্মার্ট নির্মাণের কারণে। প্রথবারের মতো সিনেমা হলে দর্শক দেখতে চলেছে তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা “ঊনপঞ্চাশ বাতাস”। ২৩ অক্টোবর মুক্তি পেতে যাওয়া মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের সিনেমাটি দর্শক দেখতে পাবে স্টার সিনেপ্লেক্সের সবগুলো শাখায়। কারণ নিজের কাছে সৎ থাকা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল হয়তো চাননি তার প্রথম সন্তানটিকে নিয়ে টানা হেচড়া হোক এই নষ্ট ডিস্ট্রিবিউশনের। তিনি হয়তো চাননি তার প্রথম সন্তানের সাফল্যের মুকুট লুকিয়ে ফেলুক বুকিং এজেন্ট,হল রিপ্রেজেন্টেটিভ নামধারী কিছু মুখোশ মানুষ। যার ফলে একদিকে যেমন সারা দেশের দর্শকেরা বঞ্চিত হচ্ছে এবং সুন্দর গল্পের এবং শক্তিশালী নির্মাণ নিজের চোখে নিজের সিনেমা হলে দেখতে, ঠিক তেমনি নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল বঞ্চিত হচ্ছেন তার প্রথম সিনেমাটি সারাদেশের মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়া থেকে। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭