ইনসাইড আর্টিকেল

শল্যবিদ্যায় নাপিত !!!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/10/2020


Thumbnail

আমাদের দেশে  নাপিত বা নরসুন্দর বলতে এমন এক শ্রেণীর পেশাজীবিদের বুঝায় যারা বিভিন্ন ধরন বা রকম ভাবে মানুষের চুল ছাঁটেন এবং দাড়ি গোঁফ কামিয়ে থাকেন।

কিন্তু পৃথিবীর প্রথম পাস করা শল্যবিদ বা সার্জনদের মধ্যে অনেকেই প্রথম জীবনে পেশায় নাপিত ছিলেন। ইংল্যান্ডে এখনও ডাক্তারদের ‘ডক্টর’ এবং সার্জনদের ‘মিস্টার’ নাপিত বলার রেওয়াজ আছে। সার্জনদের ‘ডক্টর’ বললে ডক্টররা নাকি অপমানিত বোধ করেন ! মধ্যযুগে ইউরোপের নাপিতেরা দলে দলে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শল্যবিদ্যায় ডিগ্রি নিতে। এই নাপিতেরা যখন পেশাদার সার্জন ছিলেন না, তখন রোগীর শরীরে তাঁরা ইচ্ছেমতো ক্ষুর চালাতেন।

নরসুন্দর বা নাপিত বাংলাদেশের সর্বত্রই বিরাজমান। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে নাপিত ছিল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান স্বরূপ। আগেকার দিনে হিন্দু সস্প্রদায়ের বিয়ে ও জন্ম উৎসবে নাপিতরা কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। মুসলিম পরিবারবর্গও নবাগত শিশুর মাথা ন্যাড়া করার জন্যে নরসুন্দরের দ্বারস্থ হতো। হিন্দু পরিবারে কারও মা অথবা বাবা মারা গেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর নাপিত তার ছেলেদের মাথা ন্যাড়া করে দেয়। তবে খুব জরুরি প্রয়োজনে এবং বয়স্কদের চুল দাড়ি কামাতে অনুরোধে অনেক নাপিত বাড়িতে গিয়েও চুল ছেঁটে দেন।

গ্রামের বাজারে বা শহরের অলিতে গলিতে নাপিতদের নির্দিষ্ট দোকান আছে। সেখানে লোকেরা তাদের চুল, দাঁড়ি কাটা, ছাঁটা, নখ কাটা এবং ছোটখাট কাটাছেঁড়ার কাজ করায়। এসব সেবা প্রদানের মাধ্যমেই নাপিত উপার্জন করে থাকে। এই উপার্জন অর্থ হতে পারে, আবার কোন দ্রব্যসামগ্রীও হতে পারে। আগেকার দিনে নাপিতদেরকে কাজের বিনিময়ে সাধারণত দ্রব্যসামগ্রী দেওয়া হতো। এই বিনিময় প্রথার নাম ছিল যজমানি ব্যবস্থা। গ্রামের লোকজন সারা বৎসরের সেবার বিনিময়ে, নাপিতদের ফসলের মৌসুমে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য দিত। চালাকিপনা, রসিকতা, আড্ডাবাজি ও গল্প বলায় নাপিতদের বিশেষ দক্ষতা ছিল। এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে এবং এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে তথ্য আদানপ্রদান হতো নাপিতদের মাধ্যমে। এছাড়া শিশুর জন্ম-সংবাদের বাহক হিসেবে তারা কাজ করত। আর নবজাতক ছেলে শিশু হলে সে খবর সরবরাহ করে উভয় পক্ষ থেকে তারা উপহার পেত।

নরসুন্দরদের সামাজিক অবস্থানও মিশ্র ধরনের। কেউ কেউ মনে করেন, নাপিত এসেছে  ক্ষত্রিয় পিতা এবং শূদ্র মাতার পরিবার থেকে। অনেকের ধারণা নাপিতের উৎপত্তি দেবতা  শিব থেকে, যিনি তাঁর স্ত্রীর নখ কেটেছিলেন। নাপিতরা কতিপয় অনুসস্প্রদায়ে বিভক্ত, যথা আনারপুরিয়া, বামানবেন, বরেন্দ্র, রাঢ়ী, মাহমুদাবাজ, সপ্তগ্রাম, সাতঘরিয়া, খোট্টা ইত্যাদি।। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়, অনেক গুল নিন্মসম্প্রদায়ের কাছে অস্পৃশ্যী হলেও নাপিতের হাতে পানি তারা পান করতেন।  অধিকাংশ নাপিতই বৈষ্ণব। ধর্মীয় কাজে তারা ব্রাহ্মণদের  পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করে থাকে। তাদের মৃতদেহ আগুনে পোড়ানো হয়। মৃত্যুর একত্রিশ দিন পর শাস্ত্রমতে তাদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। খাবারদাবার পরিবেশনে তারা হিন্দুশাস্ত্র মেনে চলে। বৈষ্ণব নাপিত মাংস খায় না, কিন্তু মাছ খায়।

শহুরে নাপিতদের অবস্থান ও চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে নারীপুরুষ বা ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য সেলুন আছে।  সাধারণত মেয়েদের জন্য আলাদা নরসুন্দর থাকে। মেয়েদের নরসুন্দরও মেয়ে হয় এবং তারা সাধারণত পার্লারে তাদের চুল কাটা, অবাঞ্ছিত লোম উত্তোলন সহ রূপ চর্চার যাবতীয় কাজ করে থাকে। । শহুরে নাপিতরা চুল কাটার আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দক্ষতার সাথে সেলুনে কাজ করে। গ্রামের নাপিতদের চেয়ে তাদের উপার্জন অনেক বেশি। শহুরে নাপিত চুলকাটা ও কেশসজ্জা এবং কখনও বা মাথা মালিশ করা ছাড়াও অন্য অনেক সেবা দিয়ে থাকেন। গ্রামের নাপিতরা কেশবিন্যাস বা মালিশের কাজ  প্রায় করে না বললেই চলে। সম্প্রতি মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও নরসুন্দর হতে দেখা যায়। কারণ এই পেশাটি এখন একটি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭