ইনসাইড গ্রাউন্ড

আন্দ্রেস এস্কোবার: ছয়টি বুলেটে আত্মঘাতী গোলের মূল্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/10/2020


Thumbnail

দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমাংশের দেশ কলম্বিয়া।ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নামানুসারে রাখা এই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, খুন, হত্যা আর আন্তর্জাতিক মাদকের কারবারের জন্য পুরো পৃথিবীতে ছিল কুখ্যাতি। সারাবিশ্বের ৮০% কোকেইন সরবরাহের বাজার ছিল কলম্বিয়া। তবে ফুটবলকে কেন্দ্র করে তখন কলম্বিয়ানরা নিজেদেরকে নতুন পরিচয়ে বিশ্বে উপস্থাপন করতে জোর প্রচেষ্টাই চালিয়ে যেতে চেয়েছিলো। 

নব্বইয়ের দশকে কলম্বিয়ার ফুটবল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সেরা আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। ফিফার র‍্যাংকিয়ে তাদের অবস্থান ছিল চতুর্থ। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বও দুর্দান্ত প্রতাপে শেষ করেছিল ল্যাটিন আমেরিকার এই ফুটবল দল। বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনার মত দলকে আর্জেন্টিনার মাটিতে হারিয়েছিলো ৫-০ গোলের ব্যবধানে।

১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ মূলপর্বের আয়োজক দেশ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যতম হট ফেভারিট হিসেবেই এই আসরে অংশগ্রহণ করে আন্দ্রেস এস্কোবারের দল। কালো মানিক খ্যাত ফুটবলার পেলে তো ভবিষ্যতবাণী করে বলেই দিলেন এই আসরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে কলম্বিয়া। বলার যথেষ্ট কারণও ছিল বটে। বিশ্বকাপের আগে খেলা ২৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে একটিতে মাত্র পরাজিত হয় কলম্বিয়ানরা। সেই হিসেবেই আকাশচুম্বী আশা নিয়ে দলের পোস্টার বয় আন্দ্রেস এস্কোবারের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ স্কোয়াড ঘোষণা করে কলম্বিয়া। 

গ্রুপ লিগ পর্বের প্রথম ম্যাচে রোমানিয়ার বিপক্ষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৩-১ গোলে হেরে বসে এস্কোবাররা। বিষাদে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ যাত্রায় কলম্বিয়ার দ্বিতীয় ম্যাচকে ঘিরেই ছিল সকলের প্রত্যাশা। স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেই কেবল টিকে থাকার বাতি জ্বলবে। দুই দলেরই প্রত্যাশার পারদ আর টানটান উত্তেজনায় ২২জুন শুরু হয় ম্যাচটি। আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণে দুই দলেরই জয়ের জন্য চরম তাড়না। হঠাৎ করেই ম্যাচের ৩৩ মিনিটে রক্ষণভাগের খেলোয়াড়, কলম্বিয়ানদের আশার আলো এস্কোবার যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়ের আক্রমণ ব্লক স্লাইড করে রুখতে গিয়ে করে ফেলেন আত্মঘাতী গোল। ক্ষোভে ফেটে পড়ে হলুদ জার্সির সমর্থকেরা। নিস্তব্ধতা, বিষন্নতা আর হতাশার পরেও কলম্বিয়া বারবার ঘুরে দাড়াতে চেয়েছিলো কিন্ত কোনভাবেই মার্কিনিদের প্রাচীর ভাঙ্গা যায়নি৷। ভাগ্য যেন কলম্বিয়ার সাথে ছিল না কোনভাবেই। ৫২ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় গোল হজম করে স্বপ্নভঙ্গের শুরুর শুরুটা হয়ে যায় তখন। শেষাবধি ৯০ মিনিটে কলম্বিয়া এক গোল শোধ করলেও ২-১ গোলে ম্যাচটি জিতে নেয় ইউএসএ। টানা দুই ম্যাচ হেরে যাওয়ায় বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় কলম্বিয়াকে। পরের ম্যাচ অবশ্য তারা সুইজারল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়েছিলো। 


বিশ্বকাপ শেষে দেশে ফিরে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে এস্কোবার চলে যান নিজ শহরে৷ শহরের একটি পানশালাতে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন। ভোর সকালে পানশালা থেকে বের হয়ে পার্কিং লটে গাড়ি নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে থাকাবস্থায় কয়েকজন লোক এসে তাকে আত্মঘাতী গোলের জন্য গালিগালাজ করতে থাকে৷ এস্কোবারও বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন এটা তার অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিল। কিছু না শুনে এক পর্যায়ে তারা পিস্তল বের করে এস্কোবারের বুকে ছয় রাউন্ড গুলি করে। আর প্রতিবার গুলি করার সময়ে ঘাতকদের দল `গোল` `গোল` বলে উল্লাসে মেতেছিল। রক্তাক্ত এস্কোবার যখন মাটিতে লুটিয়ে কাতরাচ্ছিল তখন তারা উল্লাস করতে করতেই পালিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক এস্কোবারকে মৃত ঘোষনা করে৷ এই হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পরে পুরো বিশ্বে। প্রতিটা আন্তর্জাতিক মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে এস্কোবারের রক্তাক্ত লাশের ছবি। একটা আত্মঘাতী গোলের জন্য কাউকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করা যায়; এটাই যেন প্রথম দেখলো বিশ্ব। শুধু তাই নয় কোন ফুটবল তারকার খুন হওয়ার ঘটনা এটিই ছিল প্রথম।

এস্কোবারের শেষকৃত্যে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার জনগণ অংশ নিয়েছিল। হত্যাকারী হিসেবে ঘাতক হেমবারতো মুনিজকে দোষী সাব্যস্ত করে ৪৩ বছর সাজা দেওয়া হলেও সদাচরণের জন্য তার সাজা কমিয়ে ১১ বছর করা হয় এবং ২০০৫ সালে তাকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয়। ২০০২ সালে নিজ শহর মেডেলিনে তার সম্মানার্থে একটি প্রতিকৃতি বসানো হয়। এখনো কলম্বিয়ানরা তাকে শ্রদ্ধা সাথে স্বরণ করে। তার মৃত্যুতে শোক পালন করে। মাঠে আলোকচিত্র নিয়ে খেলা দেখতে যায়। মৃত্যুর পরে এস্কোবারের নামে একটি দাতব্য সংস্থা চালু করা হয়, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা ফুটবল প্রশিক্ষণ নিতে পারে। বিশ্বকাপে ভুল গোলের জন্য প্রাণ হারানো এস্কোবারের প্রকল্পে এখন তৈরি হয় পরবর্তী কোন বিশ্বকাপ স্কোয়াডের জন্য নতুন খেলোয়াড়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭