কালার ইনসাইড

ঊনপঞ্চাশ বাতাস : তুমি আমার অর্ধেকটা দম হয়েই থেকো

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 24/10/2020


Thumbnail

“যদি আকাশের গায়ে কান না পাতি, তোমার কথা শুনতে পাবো না”, নির্বাক সিনেমায় অর্ক মুখার্জীর এই গানটায় অদ্ভুত রকমের আচ্ছন্ন করে রাখার মতো একটা ব্যাপার ছিলো। সম্ভবত বাংলাদেশি কোনো সিনেমায় বেজবাবা সুমনের কন্ঠে “প্রথম ঝড়ে পড়া শিউলিটা” কিংবা সৌরিনের কন্ঠে চোখের কোনে জল জমানো “এ শহর জানে আমার সব কিছু” এই গানগুলোর মতো সিনেমা হলে বসে স্ক্রিনপ্লে আর গল্পের উত্তেজনার সাথে পারফেক্ট  টাইমিংয়ের গান পায়নি বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমীরা।

হ্যা ! যে গানগুলোর কথা বলছিলাম সেগুলো গত ২৩ অক্টোবর সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়া মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের সিনেমা “ঊনপঞ্চাশ বাতাসের”।

আশির দশক আর নব্বইয়ের মাঝামাঝির স্বর্ণযুগ পেছনে ফেলে আসা বাংলা সিনেমার একালে এসে সিনেমা হল বিমুখ দর্শকদের আবার হলে নিয়ে আসার উপলক্ষ হয়েছে খুব কম। এদেশের সিনেমায় শুধুই বিনোদনের নামে বস্তাপচা গল্পে সিনেমা নির্মাণ হয়েছে প্রচুর, পাশাপাশি মাথার উপর দিয়ে যাওয়া বা হাই থট ট্যাগধারী সিনেমাও নির্মিত হয়েছে অনেক।

তবে মাসুদ হাসান উজ্জ্বলকে যারা আগে থেকেই তার কাজের জন্য চিনে থাকেন সেই সকল দর্শক বেশ ভালোভাবেই আশায় বুক বেধেছিলেন তার প্রথম সিনেমা ঊনপঞ্চাশ বাতাস নিয়ে। প্রথম সিনেমার গল্পে তাই বিনোদনের জন্য প্রেম আর সেই প্রেমের ছলেই জীবনবোধের পারফেক্ট মিশ্রণে মাসুদ হাসান উজ্জ্বল বানিয়েছেন “ঊনপঞ্চাশ বাতাস”।

এই সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অয়ন আর নীরার মোড়কে ছিলেন ইমতিয়াজ বর্ষণ আর শার্লিন ফারজানা।
সত্যিকারের প্রেম করেছেন কখনো ? যদি আপনার এখনও মনে থাকে প্রথম প্রেমের স্মৃতি অথবা খুব ভালোবেসে ফেলা প্রেমিকাকে একদম আপন করে পাবার তীব্র আকুতি যদি কখনো আপনাকে গ্রাস করে থাকে প্রবলভাবে তাহলে আপনার জন্যই “ঊনপঞ্চাশ বাতাস”।

এখনও পর্যন্ত ভালোবাসার সংজ্ঞা কি কেউ দিতে পেরেছে? হয়তো পারেনি, কারণ ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয়না, ভালোবাসা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে আলাদা আলাদা অনুভূতি নিয়ে হাজির হয়। ঠিক যেমন নীরার জীবনে প্রেম এসেছিলো কল্পনার ভেলায় চড়ে খুব ভীড়ের মাঝে সদরঘাট, ফার্মগেট বা গুলিস্থানের কোনো এক ব্যস্ত রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকা আয়নকে দেখে। কল্পনায় দেখা সেই ছেলেটাই যখন বাস্তবে এসে ধরা দেয় তখন একজন প্রেমিকার অনুভূতি কেমন হয় সেটি দেখা যাবে অয়ন আর নীরার ভিন্নধর্মী প্রেমের গল্প ঊনপঞ্চাশ বাতাসে।

প্রেম মানেই পাগলামি, আর প্রথম প্রেম হলে সেই পাগলামিটা যে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার কথা, ঠিক তেমনটাই হয়েছিলো নীরার জীবনে। নীরার কল্পনার প্রিয়মত মানুষটি বুক পকেটে টোষ্ট বিস্কুট রাখে, হাতের ময়ূরের পাখনার ছোঁয়াতে নীরাকে ছুঁয়ে দেয় আলতো করে। কল্পনাটা বাস্তবে ভর করলে নীরাও ফ্লাস্ক থেকে চা হাতে নিয়ে অয়নের সাথে ভীড় খোঁজে। দস্যি কোনো প্রেমিকার মতো হানা দেয় প্রিয়মতো প্রেমিকের বাড়িতে।

গল্পের নায়ক অয়ন ছেলেটা বেশ মানবিক। অজ্ঞাত বা অপরিচিত কারো জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে তার ভালো লাগে। নিজে মেডিকেল সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হওয়াতে ওষুধের স্যাম্পল তুলে দেয় অসহায় রোগীদের হাতে। সেই অয়নের জীবনে নীরার মতো প্রেমিকা যেন অয়নের জীবনটাই বদলে দেয়। এমন একজন প্রেমিকাই সব ছেলের আরাধ্য থাকে, যে আজকালকার ইন্টারনেট আর অনলাইন নির্ভরতার সময়েও পরিমিত ভালোবাসার সাথে সাথে ইমপ্রেস নামক ইংরেজি টার্মকে সহজ করে অয়নের জীবনে সিনেমা হলের পর্দায় তুলে আনবে অয়নের ছোট্ট বাসার কোনে থাকা বাথরুমটাতে কাপড় ধোবার ছলে।

গল্পকে শুধু গল্পর মতো দেখালে হয়না, ভালো গল্পের সাথে সাথে পরিচালকের দক্ষতার উপরেও চলচ্চিত্রটির  সত্যিকারের চলচ্চিত্র হয়ে ওঠা নির্ভর করে। মাসুদ হাসান উজ্জ্বল তার শৈশব থেকে জীবনের প্রতিটি বাকে শিখতে শিখতে বড় হওয়া এবং সিনেমাজ্ঞানে পরিপক্ক হবার এই লম্বা জার্নির পুরোটাই হয়তো ঢেলে দিয়েছিলেন তার নির্মিত ঊনপঞ্চাশ বাতাসে। ছোট ছোট শ্রুতিমধুর ডায়লগেও কিভাবে জীবনবোধ ঢুকিয়ে দেওয়া যায় সেটির একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে “ঊনপঞ্চাশ বাতাস” সিনেমাটি।

সিনেমার শুরুতেই নীরার কন্ঠে একটি ডায়লগ ছিলো “আমি অর্ধেকটা দম নেই বাকীটা একসাথে নেবো বলে”। এই সিনেমার সবচেয়ে মুগ্ধকরা আর সেরা দৃশ্য ছিলো নিঃশ্বাসের বিয়ে দেওয়া। প্রকৃতিকে সাক্ষী নিঃশ্বাসের বিয়ে দিয়ে কয়জন প্রেমিক প্রেমিকাই বাকী জীবনের জন্য একে অন্যকে সপে দিতে পারে। প্রিয়মতো কষ্টে থাকলে প্রেমিকার এমন উতল হয়ে ওঠা কম সিনেমাতেই দেখেছে বাংলা সিনেমার দর্শকেরা, সেটাই নীরা করে দেখিয়েছে অয়নের জন্য।

অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করা অয়ন সিনেমার শেষভাগেও তার মানবিক আর মূল্যবোধের যায়গা থেকে একচুল সরে দাঁড়াননি। এই কাজটি সম্ভব হয়েছে মাসুদ হাসান উজ্জ্বল পরিচালক হওয়াতেই। কারণ দাস কেবিনের মাসুদ হাসান উজ্জ্বল কিভাবে তার নিজের চরিত্র থেকে সময় আর বাংলা সিনেমার ভাঁড়ামির চাপে বদলে যাবেন বলুন। নিজের জীবন দর্শন ঠিকঠাক তুলে দিয়েছেন নায়ক চরিত্র অয়নের কাঁধে। শান্ত অয়ন অসাধারন অভিনয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন দর্শক হৃদয়ে।

ওহ! অয়নের সাথে সাথে সেই দায়িত্ব নায়িকা নীরার ভাগেও ঠিকঠাক ফেলেছেন পরিচালক। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্রী নীরাকে গল্পের শেষ পর্যন্ত নিজের কাজের প্রতি একাগ্রতা ধরে রাখার কাজটি গল্পের ছলেই টেনে নিয়ে গেছেন। মাসুদ হাসান উজ্জলের যেমন জীবনের সকল সিনেমা সাধনা তার সিনেমায় ঢেলে দিয়েছেন ঠিক তেমনি নায়িকা নীরা তার শিক্ষাজীবনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রাপ্ত জ্ঞান তার প্রিয় মানুষটিকে পাবার জন্যই সাধনা করে গিয়েছেন পর্দায়। একটা সিনেমায় একসাথে দর্শককে হাসানো, কাঁদানো এবং ভাবানোর কাজটা হয়তো শুধুমাত্র পরিচালকের নামের জায়গাতে মাসুদ হাসান উজ্জ্বল বলেই সম্ভব হয়েছে।

সিনেমার শেষে হয়তো প্রতিটি দর্শক বলতে বাধ্য হবেন যে এমন একটা প্রেমেই হয়তো পড়তে চেয়েছিলেন আপনিও। যেখানে আপনার প্রিয় মানুষটি সারা জীবনের জন্য হয়ে থাকবে আপনার বাকী অর্ধেক দম হিসাবে।
 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭