ইনসাইড আর্টিকেল

বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার হাল-হকিকত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/10/2020


Thumbnail

আপনারা যারা বাংলাদেশে বসে বিজ্ঞান পড়ছেন- একটা ট্রাজিক অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ধারণা ছিল আমি সায়েন্স পছন্দ করি না। ব্যাপারটা যে ঠিক না এটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। আমার এ ধারণা যেসব কারণে তরি হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো- একটা স্টোরির অভাব।

সায়েন্স একটা প্যারাডাইম বা স্টোরির উপর ভর করে চলে। স্টোরি মানে কিন্ত বানানো বা আজগুবি কিছু না, বলতে পারেন একটা ফ্লো চার্ট এর মতো। একটার পর আরেকটা ঘটছে- অথবা কারণ এবং ফলাফলের একটা সংযোগ আছে। দুয়েকটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।

জার্মান বিজ্ঞানী এরুইন শ্রোডিঙ্গার ছিলেন ফিজিসিস্ট। একজন জার্মান হিসেবে শ্রোডিঙ্গার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন। জার্মান ফিজিসিস্ট হিসেবে এটাও দেখেছেন যে বিজ্ঞানীরা ছিলেন এ যুদ্ধের ফুয়েল। চারিদিকে বোমার যে ভয়াবহতা এটা দেখে তিনি খুবই আঁতকে উঠেছিলেন। কিন্ত সাথে সাথে একজন ফিজিসিস্টের র‍্যাশনাল মাইন্ড দিয়ে চিন্তা করেছেন- বোমাগুলো এতো নিখুঁত ভাবে পড়ছে, আগের যে কোন সময়ের চেয়ে টার্গেটকে বেশী নিখুঁতভাবে আঘাত করছে কেন ? বুদ্ধিমান শ্রোডিঙ্গার বুঝতে পেরেছিলেন যে এর মূলে রয়েছে কোন একটা কোড। একটা কোডই পারে রিপিটেটিভলি নিখুঁতভাবে লক্ষ্যকে ভেদ করতে।

জার্মানিতে হিটলার ইউজেনিক্স নিয়ে অনেক আগ্রহী ছিলেন- কিভাবে মানুষের আদর্শ প্রজাতি বানানো যায় এটা নিয়ে হিটলার ছিলেন যাকে বলে অবসেসড। শ্রোডিঙ্গারকেও স্বাভাবিক ভাবে এ চিন্তা স্পর্শ করেছিল। শ্রোডিঙ্গার ভেবেছিলেন কিভাবে একজন মানুষের জেনেটিক ইনফরমেশন এতো নিখুঁতভাবে আরেকজনের মধ্যে ট্রান্সমিটেড হয় ? এর মূলেও কি আছে কোন কোড ? কম্পিউটার প্রোগ্রাম যেমন একটা কাজ নিখুঁতভাবে করতে পারে ঠিক এরকম কোন একটা কোড কি মানুষের ইনফরমেশনগুলো একজনের মধ্যে থেকে আরেকজনের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে ? হাইজেনবার্গ তার এ ভাবনাকে- `What is Life?` টাইটেল দিয়ে একটা বই আকারে লিখে ফেললেন ? একজন ফিজিসিস্ট হয়ে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন ভেবেছেন- যেটা ছিল প্রায় রেভুল্যশনারি। এরপর লাইফ সায়েন্স কমিউনিটির সব বড় বড় বিজ্ঞানীরা সে কোডটা কি জানতে চেষ্টা করলেন যেটার সূত্র ধরে আবিষ্কৃত হয় ডিএনএ।

একজন সায়েন্টিস্টকে এর জন্য আরেকটা গল্পের প্লট ভাবতে হয়েছে । বংশবৃদ্ধি করে এরকম একটা অণুজীব থেকে যদি একটা একটা করে ক্যামিকেল কম্পোনেন্ট সরানো যায় এবং এমন একটা কিছু যদি পাওয়া যায় যেটাকে সরালে আর পরবর্তী জেনারেশনে এ ইনফরমেশন ট্রান্সফার হবে না সেটাই তাহলে হবে এ জেনেটিক কোড।

ডিএনএ তো জানা গেল কিন্ত এটা দেখতে কেমন- এ গল্পটা তৈরি করেছিলেন ওয়াটসন এবং ক্রিক। তারা একটা থ্রিডি মডেল বানিয়েছিলেন। সারাদিন একসাথে থাকতেন এবং এটা নিয়ে কথা বলতেন দুইজন। কলিগরা বিরক্ত হয়ে যেতেন। দুষ্ট বাচ্চারা যেরকম সোশ্যাল গেদারিং নষ্ট করলে তাদেরকে আলাদা রুমে বসিয়ে রেখে শাস্তি দেয়া হয় - এ দুইজনকেও প্রায় আলাদা একটা রুমে বসিয়ে দেয়া হয়। দুইজন বসে বসে খেলতে খেলতে `ট্রায়াল এন্ড এরর` এবং অন্য কিছু সায়েন্টিস্টদের সহায়তায় বানিয়ে ফেললেন মডেলটা। এর জন্য পেলেন নোবেল পুরস্কার।

চিন্তা করুন- আজকে দুইজন ভদ্রমহিলা ক্রিস্পার এর জন্য নোবেল পেলেন। এর জন্যে তাঁরা একটা ব্যকগ্রাউন্ড স্টোরি ভেবেছেন (বা খুঁজে নিয়েছেন)। একটা ব্যাকটেরিয়া কি করে একটা ভাইরাসকে চিনে রাখছে ? দেখা যাচ্ছে ব্যাকটেরিয়াটি একটা ধারালো কাঁচি দিয়ে ভাইরাসের ডিএনএ কেটে নিজের কাছে রাখছে। তো ব্যাকটেরিয়া যদি একটা ভাইরাসের ডিএনএ কাটতে পারে আমরা কিভাবে এটা করতে পারি ? এ কাঁচিটাই তাঁরা বানিয়েছেন দুজনে মিলে।

আমরা যারা সায়েন্স পড়েছি সবাই- ক্যাল্কুলাস করেছি, প্রোবাবিলিটি শিখেছি অথবা লগারিমদের মতো টুল ব্যবহার করেছি । কোনদিন আমাদের (অন্তত আমার তো বটেই)- মনে হয়নি আচ্ছা, এই লগারদিম আমি এখন কোথায় ব্যবহার করতে পারব ? অথবা বেইসের সূত্রটা ঠিক কোন কাজে লাগছে ? কেনই বা এটা আমরা চিন্তা করছি। একটা ইকুয়েশনের লোয়েস্ট ভ্যালু বের করার অংকটা করার সময় কোনদিন মনে আসে নাই- এরকম একটা কিছু বাস্তবে আমার কখন লাগতে পারে ? কখন আমি এই স্কিলটা ব্যবহার করতে শিখব ?

সায়েন্স থেকে আপনি এ গল্প বা প্যারাডাইমটা বাদ দিয়ে দিন- সায়েন্স একটা ভুষিমালে পরিণত হবে। অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার হলো সায়েন্সের প্রায় কোন ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয় না, হবে এই দুরাশা আমি করি না। আপনারা যারা সায়েন্স পড়েছেন- যদি আসলেই কিছু শিখতে চান, এই স্টোরিটা নিজে থেকে ভাববেন। কেন আপনি এটা শিখছেন নিজেকে এ প্রশ্নটা প্রথম করবেন।

প্রায় কোন ক্যাল্কুলেশন না করেও আপনি একজন শার্প সায়েন্টিস্ট বা, ভাল ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবেন। শুধু যোগ-বিয়োগ গুণ ভাগ জেনেই। আপনার যতো জটিল হিসেব এগুলো করার জন্য কম্পিউটার আছে। শুধু দয়া করে ক্যাল্কুলেশনের পেছনে জীবনটা কাটিয়ে দিবেন না।

ফ্রেঞ্চ ডিডেক্টিভ স্টোরিতে যেমন বলে- Find the woman, আপনি শুধু নিজেকে বলবেন - আসল কাহিনীটা কি ? আপনি কোথায় এসেছেন, কোথায় যাচ্ছেন ?

একটা জটিল জিনিসকে ওয়াইড রেঞ্জ অব অডিয়েন্সের কাছে কি করা ব্যাখ্যা করার যায় এটাও শিখবেন প্লীজ। কোন প্রকার ইকুয়েশন বা জটিল কথাবার্তা ব্যবহার না করে আপনি যদি একজন পড়াশোনা জানা মানুষকে একটা জটিল বিষয় সহজ করে গল্প আকারে বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বুঝাতে পারেন, আপনি আর যাই হোক বড় গল্পটা মিস করবেন না। আমার সামান্য অভিজ্ঞতা বলে - স্মার্ট মানুষেরা এ কাজটি বেশ পারেন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭