ইনসাইড আর্টিকেল

বর্গী ছিল দেশে !!!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 29/10/2020


Thumbnail

খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে

ধান ফুরোলো পান ফুরোলো খাজনার উপায় কি?

আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি। 

ছোট বেলায় আমরা এই ছড়া গানটি শুনে ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনা মনে না থাকলেও অনেক মা’কে দেখেছি এই ছড়া গানটি শুনিয়ে তার শিশু সন্তানটিকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে। আবার সদ্য কথা বলতে পারা শিশুটিও পুতুল খেলার সময় তার পুতুলকে ঘুম পাড়ানোর সময় এই ছড়া গানটি গাইতে। কিন্তু কারা এই বর্গি ? যাদের ভয়ে তটস্ত হয়ে অবুঝ শিশুটিও ঘুমিয়ে পড়তো ?  

বর্গি অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর ধরে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে লুটতরাজ চালাত বর্গিরা। বর্গিহানা এই সময় একপ্রকার বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে পশ্চিম বাংলার সমাজজীবনে বর্গি আক্রমণের প্রভাব ছিল অপরিসীম। তাই আজও এই অঞ্চলের ছেলেভুলানো ছড়ায় বর্গি আক্রমণের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

বর্গি শব্দটি মারাঠি বারগির শব্দের অপভ্রংশ। বারগির বলতে মারাঠা সাম্রাজ্যের সেই সব অশ্বারোহীদের বোঝাত। এরা ছিল ধনগর জাতীয় এবং এদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিতেন সম্রাট নিজেই। উল্লেখ্য, এই সাম্রাজ্যের শিলাদার বাহিনীকে সম্রাট ঘোড়া বা অস্ত্রের জোগান দিতেন না, তারা নিজের রসদের প্রয়োজনে যুদ্ধ করত। 

মারাঠি ধনগর জাতীয় লোকেরা অভিযানে যাওয়ার সময় কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত বরচি। এই নাম থেকেই ধনগররা বারগির বা বর্গা ধনগর বা বর্গি নামে পরিচিত হয়। 

১৭৪০ সালের এপ্রিল মাসে আলিবর্দি খাঁন সরফরাজ খানকে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার নবাব হন। সরফরাজ খাঁর শ্যালক তথা উড়িষ্যার উপশাসক নায়েব নাজিম রুস্তম জং আলিবর্দি খাঁর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। আলিবর্দি বালাসোরের নিকট ফলওয়াইয়ের যুদ্ধে রুস্তম জংকে পরাজিত করে এবং নিজের ভাইপোকে উড়িষ্যার উপশাসক নিয়োগ করেন। রুস্তম জং এরপর নাগপুরের মারাঠা শাসক প্রথম রঘোজি ভোঁসলের সাহায্য প্রার্থনা করেন। মারাঠাদের সাহায্যে রুস্তম জং উড়িষ্যার অধিকার পুনরুদ্ধার করেন। এদিকে মারাঠারা বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ শুরু করে। আলিবর্দি পুনরায় উড়িষ্যায় এসে রুস্তমকে পরাজিত করেন। কিন্তু তিনি মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই ভোঁসলে মারাঠা সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতকে অশ্বারোহী বাহিনীর নেতা করে বাংলায় পাঠান। তারা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে ব্যাপক লুটতরাজ চালাতে থাকেন। 

পরবর্তী দশ বছর বর্গিরা নিয়মিত বাংলায় লুটতরাজ অব্যাহত রাখে । বর্গিসন্ত্রাস এবং বর্গিদের অতর্কিত আক্রমণ পদ্ধতির সামনে নবাব বাহিনী ছিল আসহায়। আলিবর্দি খাঁ যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের পরিচয় দিলেও বর্গি আক্রমণ ঠেকাতে সমর্থ হননি। নবাবের বাহিনী মারাঠা অশ্বারোহীদের গতি ও দক্ষতার সামনে প্রকৃত অর্থে ছিল অসহায় । কেবলমাত্র গঙ্গা-হুগলি নদীই বর্গি হানা ঠেকাতে সক্ষম হয়। মজার ব্যাপার হল কয়েকটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া বর্গিরা হুগলি নদী পার হতে পারেনি।

কলকাতার পুরনো বানানে মারহাট্টা খাত যা বর্তমানে রূপ নিয়েছে মারাঠা খাদ নামে।  ১৭৪২ সালে বর্গি অর্থাৎ মারাঠাদের সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে কলকাতা শহরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে খনন করা হয় এই খাদ। এটি তিন মাইল দীর্ঘ একটি পরিখা। যদিও বর্গিরা শেষ পর্যন্ত কলকাতা আক্রমণ করেনি। ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে ইংরেজ বসতি লুণ্ঠন করলে এই খাতটি অকার্যকরী প্রমাণিত হয়। খাদটির নির্মাণকাজ কখনই সম্পূর্ণ হয়নি। ১৭৯৯ সালে সার্কুলার রোড নির্মাণের সময় এর অধিকাংশ বুজিয়ে দেওয়া হয় অবশিষ্টাংশ বোজানো হয় ১৮৯২-৯৩ সালে। এই খাদটির অবস্থানের জন্য সেকালে কলকাতাবাসীদের "ডিচার্স" "Ditchers" বা "খাদবাসী" নামে অভিহিত করা হত। ঐতিহাসিক দের মতে এই খাদ দিয়ে ঘেরা অঞ্চলটিকে মনে করা হত কলকাতার মূল নগরাঞ্চল।

১৭৫১ সালের মে মাসে আলিবর্দি খাঁ মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। এরপর বাংলায় বর্গি হানা বন্ধ হয়। কিন্তু বর্গি হানার ছড়া গান রয়ে যায় কালের সাক্ষী হয়ে। 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭