ইনসাইড আর্টিকেল

গোলশূন্য ড্র ফ্রান্স ও পর্তুগালের ছুটির দিনে বই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 30/10/2020


Thumbnail

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার কারণে পঠিত বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি আলোকিত বই সম্পর্কে কিছু না বললে চলমান `ছুটির দিনে বই` শিরোনামে আমার সিরিজ লেখা খানিকটা অপূর্ণ থেকে যাবে।

১৯৮০ সালের একেবারে শেষ দিকে  আমি ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শ্রেনির ছাত্র হই। ` ৮১ সালের মার্চ- এপ্রিল মাসে ক্লাস শুরু হলে প্রথম দিন যায় পরিচয় পর্বে। সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন হবে। শ্রেণি কক্ষে প্রবেশ করলেন, শ্রদ্ধেয় সরদার ফজলুল করিম। হাতে কিছু বই । পড়াবেন রাষ্ট্র চিন্তা পরিচিতি। ঐদিনের ক্লাসেই তিনি সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিষ্টটল এবং গ্রীক নগররাষ্ট্র, এথেন্স, গ্রীক সভ্যতার ইতিহাসের গোড়াপত্তন নিয়ে কথা বলেছিলেন। মনে পড়ে, বছরব্যাপী পরবর্তী ক্লাসগুলোতে তিনি Machiavelli, Hobbes, Locke, Roussesu থেকে karl Marx এবং Engels পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। যদিও তখন নামগুলোর সাথে এত বেশি পরিচিত ছিলাম না।

তখন থেকেই প্লেটোর রিপাবলিকের নাম শুনি এবং সহপাঠিদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি বইটি স্যারের নিজেরই অনুবাদ। বিশ্বসাহিত্যের এই চিরায়ত গ্রন্হ বা সম্পদ নাকি পৃথিবীর সেরা দশ বইয়ের একটি। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের অনুবাদে `প্লেটোর রিপাবলিক ` দু`বাংলায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি বৃটিশ লেখক ও শিক্ষাবিদ বেনজামিন জোয়েট(১৮১৭ --১৮৯৩) এর ইংরেজি থেকে এই অসাধারণ সাহিত্য ও সুকুমার নির্ভর ভাষার শৈলি ও শৈল্পিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। যা তিনি অনুবাদ করতে গিয়ে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রথম প্রকাশের পর এযাবৎ বইটির ৭ম সংস্করণ এবং ত্রয়োদশ মুদ্রণ হয়েছে। প্রথম প্রকাশনার কালে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদগন আলোচনায় অংশ নিয়ে ছিলেন। ড.কাজী মোতাহার হোসেন, ড, মুজাফফর আহমদ চৌধুরী,ড.রওনক জাহান, ড. এনামুল হক আরো অনেকে।

রিপাবলিকের বাংলা অনুবাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও হয়েছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রয়াত  অধ্যাপক সৈয়দ মকসুদ আলী এবং সম্প্রতি সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট, গবেষক, লেখক ও ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র আমিনুল ইসলাম ভুইয়া কতৃকও  অনুদিত হয়েছে। সকলই আড়াই হাজার বছর আগের প্লেটোর এমন অমুল্য  সংলাপরাজিকে আত্মস্থ করে মানব সমাজের কল্যানে প্রয়োগের একনিষ্ঠ প্রয়াস নিয়েছেন। এতে সংলাপের অবিস্মরণীয় নায়ক সক্রেটিসের অভূতপূর্ব বাগ্মিতার ভেতর দিয়ে তৎকালীন গ্রীসের রাজনীতিক ইতিহাস, এথেন্সের নগররাষ্ট্রের মধ্যে অভিজাততন্ত্রী ও গনতন্ত্রীদের সংঘটিত দ্বান্দ্বিক পরিবেশের বাস্তব এক চিত্রনাট্য ফুটে উঠেছে। বিখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিকগনের মতে এটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ দর্শনের একটি চিত্র। এটি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা, একটি ইউটোপিয়া বা কল্পচিত্র। এ কারনেই প্লেটোকে ইউটোপিয়ার অন্যতম জনক বলা হয়ে থাকে। তবু কল্পনার মধ্যেও তিনি মানবজাতির মুক্তির সহজ পথ দেখিয়েছেন।

সরদার ফজলুল করিমের অনুবাদ গ্রন্হটিতে পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫১৭। প্লেটোর সংলাপ বহুমাত্রিক রূপ পায় এর প্রথম থেকে দশম পুস্তকের নানা বিষয়ের ধারাবাহিক আলোক পাতের মাধ্যমে। প্রশ্ন ও উত্তর, আবারও প্রশ্ন, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে উপনীত হওয়া, বিরামহীন চিন্তা উদ্রেককারী প্রসঙ্গ এসেছে ক্রমানুসারে। অনুবাদক স্বয়ং বলেছেন, "মানুষের যে কোন সৃষ্টিই যৌথ সৃষ্টি , একক নয়। মানুষের জীবন কালের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্হেরও জীবনকাল থাকে। পার্থক্য শুধু ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য। তবুও গ্রন্হটির বৃদ্ধি বৈ কোন মৃত্যু ঘটে না "। এর সংলাপের সাথে অংশ নেয়া ব্যক্তিগুলোর মধ্যে সক্রেটিস প্রধান সূত্রকার ; গ্লকন ও অ্যাডিমেন্টাস,সিফালাস,থ্র্যাসিমেকাস, ক্লিটোফন, পলিমারকাস এবং নির্বাক দর্শকবৃন্দ।

মানুষের সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক জীবনের অসংখ্য অগুনিত সমস্যা ও সমাধানের দিক নির্দেশনা মহত্তম পন্থায় প্রতিভাত হয়ে উঠেছে  কালজয়ী গ্রন্হ প্লেটোর রিপাবলিকে।  সরকার,রাষ্ট্র, আদর্শ রাষ্ট্র,গনতন্ত্র, গণিত, দেবতা, দাসপ্রথা, অভিজাততন্ত্র,অভিভাবক, উচ্চাবিলাষতন্ত্র,কবি, কাব্য, সংগীত,  চিত্রশিল্প, জ্যামিতি, দর্শন,চিকিৎসাশাস্ত্র, নারী পুরুষের সমতা, উওম বিচারক, দেশরক্ষা, ন্যায় বিচার, নিদাগ মানুষ দিয়ে সেবাপ্রদান,নারীরাও শাসক থাকবে, শিশু সুরক্ষা, শ্রম সবার জন্য, সম্পদ ইত্যাদি বিষয় ক্রমযুক্তির প্রবাহে  সতস্ফুর্ততার সাথে  উঠে এসেছে। যা মনে হয় আজও প্রাসঙ্গিক ও বিদ্যমান।

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সরদার ফজলুল করিমের সাথে তাঁর প্রয়ানের কিছুকাল পূর্বেও একাধিকবার আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানে, শাহবাগস্হ ঔষধের ফার্মাসি এলাকায় কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ ঝুলানো অবস্থায় সাক্ষাৎ হয়েছে। সালাম দিয়েছি, খানিকটা সহযাত্রী হয়েছি । পরিচয় পেয়ে আনন্দিত হতেন। সার্ভিসে আমাদের অগ্রজদের কুশলাদিও জানতে চাইতেন। সব সময় বিনয়াবনত হতেন।

প্রশান্তি, ২০১৪ সালের ১৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ  প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত এ কিংবদন্তির নামাজে জানাযায় অনেক ছাত্র শিক্ষকের সাথে আমিও  অংশ নিতে পেরেছিলাম। রিপাবলিক ছাড়াও তাঁর অসংখ্য মূল এবং অনুবাদ গ্রন্হ ছাত্র ছাত্রী, পাঠক, গবেষক ও অনাদি অনাগত বইপ্রেমী মানুষের কাছে সতত, সচল, সরব থেকে সর্বদা সুখপাঠ্য হয়ে থাকবে।

২৪ আশ্বিন, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭