লিট ইনসাইড

একজন না-মানুষ ও নিপীড়িত নারীর গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 18/08/2017


Thumbnail

ক্লান্ত অবন্তি। কিন্তু চোখে ঘুম নাই। পাশের লোকটা বিঘোরে ঘুমাচ্ছে। অবন্তির চোখের সামনে ঘুরেফিরে শুধু সেই সোনালি অতীতের ছবি। চোখ বন্ধ করতেই পুরানো সেই দিনগুলো। সুখের স্মৃতি কিন্তু বড় জ্বালা দিচ্ছে। জীবনের মোড় কীভাবে ঘুরে যায় তা কেও কখনো কল্পনাও করতে পারে না। যেমন পারি নি আজকের অবন্তি।

এইতো কয় বছর আগে কত স্বপ্ন দেখতো। কত রঙ মেশানো স্বপ্ন। জীবনকে রাঙাতে কোনো রঙ সে বাকি রাখতো না। কিন্তু সেই স্বপ্ন কতদিনই বা স্থায়ী হয়েছিল? পাশে যে লোকটা মৃদু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সেই লোকটাই একদিন তাকে পাবার জন্য কী করে নি? কিন্তু আজ ...? কেমন সব এলোমেলো হয়ে যায় অবন্তির এর বেশি ভাবতে গেলেই।

তখন এইচ এস সি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল সে। নিজেও জানতো সুন্দরী বলতে যা বোঝাই তার চেয়ে বরং বেশি কিছুই আল্লাহ তাকে দিয়েছিল। তার নিটোল শরীরের প্রতি কার না আকর্ষণ ছিল। কে তাকে পাবার চেষ্টা করে নি? কিন্তু তাদের মধ্যে যে সফল হয়েছিল সেই আজ তার পাশে শুয়ে আছে। কিন্তু অবন্তির মনে শান্তি নেই একটুও। বরং কে যেন তার মগজে গরম সিসা ডেলে দিয়েছে। মাথাটা দপদপ করছে। চোখ জ্বালা করছে।

ওকে পাবার জন্য একুশটা চিঠি লেখে বলেছিল, অবন্তি একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। তাই তোমাকে আমি একুশটা চিঠি লেখলাম। আমি কি তোমার হাত ধরার অধিকার পাব? অবন্তি কোনো নিরুত্তর ছিল। যেদিন বায়ান্নটা চিঠি দিয়েছিল সেদিন বলেছিলো, মুক্তভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো বায়ান্ন। বিজয় হয়েছিল ভাষার প্রতি ভালোবাসার। আমি তোমার চোখে চোখ রেখে আকাশের সাদা মেঘ দেখতে চাই, আমি তোমার হাত ধরে সকালের সোনা রোদে হাঁটতে চাই, সন্ধ্যায় তোমার সাথে কফি হাউজে বসব বলে কতদিন কফি হাউজে বসি না। এরপর অবন্তি আর নিরুত্তর থাকতে পারে নি। নিজের সব দ্বিধা ঝেরে ফেলে দীপকে হ্যাঁ বলেছিল।

তারপর কিছুদিন কী আনন্দেই না কেটেছিল। কত স্বপ্নই না দেখেছিল। দীপ কতবার যে বলেছে, আমি মরণকে গ্রহণ করতে পারব কিন্তু তোমাকে হারাতে পারব না। কিন্তু সেই দীপ ...?

খুব বেশি সময় লাগে নি দীপের পাল্টে যেতে। কত কিছুই তো ঘটে। অবন্তির জীবনেই তেমনি ঘটে গিয়েছিল জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটা। গৃহ শিক্ষক দিয়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছিল সে। চার বছর ধরে পড়াতো অবন্তিকে। কখনো কোনো খারাপ আচরণ করে নি। পরিবারের সবাই বিশ্বাস করতো। কিন্তু যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন কেউ বাসায় ছিল না। অবন্তিকে পড়াতে এসে হঠাৎ করেই ওর উপর চড়াও হয় শিক্ষক বেশে অমানুষটি।

শুধু পশুবৃত্তি চরিতার্থ করেই শান্ত হয় নি সে। অবন্তির অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে কিছু ছবি তোলে ও ভিডিও করে। তারপর চলে যায়। জ্ঞান ফেরা অব্দি বাসায় কেউ ফেরেনি। অবন্তি ভেবেছিল কেউ কিছু জানবে না। সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু কয়দিন পর অবন্তির বাবার কাছে ফোন করে টাকা দাবি করে। দেবে কি দেবে না এই দোলাচলে দুলতে দুলতেই পাড়ার ছেলেদের হাতে অবন্তির ছবি আর ভিডিও পৌঁছে যায়। অবন্তির ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ভাই আর বাবাকে কুটকথা শুনতে হয়। বাধ্য হয়ে বাসা পাল্টাতে হয়। সুখী একটা পরিবার কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অবন্তির বাবার সড়ক দুর্ঘটনাটা জীবনটাকে আরও নতুন করে চেনায়। হাসপাতালে ভর্তি বাবা-সংসারে টাকা নাই। প্রতি মুহুর্তে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করা। জীবনে টিকে থাকার তাড়না–জীবনকে এলোমেলো করে দিলো।

এরমধ্যে অবন্তি অনেক চেষ্টা করে দীপের সাথে দেখা করেছিল। সেখান থেকে যে উত্তরটা এসেছে সেটা ভাবনার অতীত। অবন্তি বলেছিলো, দীপ তুমি তো সব জানো , কী করবে এখন ?

আমার কী করার আছে ?
তুমি না আমায় ভালোবাসো।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছো ?
কেন এ কথা বলছো ?

তুমি সমাজে এখন ঝুটা, তোমায় বিয়ে করলে নানাজনে নানা কথা বলবে। আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তুমি তোমার পথ দেখো।

পিছনে আর ফিরে তাকায় নি দীপ। আর জীবন থেকেও হারিয়ে যায় অবন্তি। বাসায় ফেরার পথে বার বার মনে হয়েছে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু কে যেন বার বার ফিরেয়েছে। কোনো এক অজানা কারণে পারে নি। কপালে যার অনেক দুঃখ থাকে সে মরবে কেন ?

টাকা টাকা করে জীবন তাগিদ দিতে থাকে। টিউশনি বা চাকুরী করে নিজে চলা যায়। কিন্তু বাবার চিকিৎসার খরচ, ছোট ভাইয়ের স্কুলের বেতন কিংবা সংসার চলে না। বাসা ভাড়া বাকি পড়ে যায় তিন চার মাসের। বাড়িওয়ালা বাসা ছাড়তে বলে।

কিছু একটা করতে হবে। করতেই হবে। একে ওকে বলতে থাকে কিছু একটা উপায় করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই যখন কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না সে তখনই একদিন মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ আসে, ‘টাকা ইনকাম করতে চাও?’
অবন্তি লিখে, কীভাবে?
উওর আসে, তুমি যদি সত্যিকারের মেয়ে হও আমাকে ইমোতে কল দাও।
কল দেয় অবন্তি।

এতসব চিন্তা করে হঠাৎ আজ অবন্তির মনে হলো সেই সময় ভালো একটা সঙ্গ পেলে আজ তাকে এই জীবনে আসতে হতো না। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে পারলো না সে। দীপের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ওর দিকে তাকিয়ে বললো, কি ঘুমাও না কি?

অবন্তি বললো, না ঘুম আসে নি।

ভালোই হয়েছে। আমি ডাকবো ভাবছিলাম। কথা বলা যাক। যেই আমার বেডে আসে তাঁর সাথে আমি এই কাজটা করি। শেষ রাতের দিকে গল্প করি। তোমাদের মত মেয়েদের জীবনের গল্প শুনতে আমার ভালো লাগে।

অবন্তির ঘোর লাগে। কাল রাতে যখন দীপের রুমে আসে। দীপ তখন একটু মাতাল প্রায়। এমনেই গত পাঁচ বছরে অবন্তির চেহারা যথেষ্ট পাল্টে গিয়েছে। প্রতি রাতে হাত বদল হতে হতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে আর খুঁজে পায় না। কিন্তু দীপও চিন্তে পারবে না সেটা ও ভাবে নি। বাসার ঠিকানাটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভেবেছিল আসবে কি না? কী এক অচেনা টান তাকে টেনে এনেছিল কে জানে?

দীপ একটানা বকবক করে যাচ্ছে। অবন্তির কানে কিছুই ঢুকছে না। হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন ওকে কাঁপিয়ে দিলো, কীভাবে এই পথে এলে?

এ প্রশ্নের কী উত্তর দিবে অবন্তি? সেদিন যদি ঐ ভাবে ফিরেয়ে না দিত তাহলে ...। আর ভাবতে ভালো লাগছে না। এতক্ষণে অবন্তির ঘুম পাচ্ছে। সে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। কোনো উত্তর না পেয়ে দীপ পাশ ফিরে তাকিয়েই চমকে উঠলো, হঠাৎ করেই মনে হল এই মেয়েটাকে সে চেনে, জন্মে জন্মে চেনে। রাতে মাতাল ছিল বলে বুঝতে পারে নি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একটা প্রশ্ন জাগলো মনে, অবন্তি এত নিচে নামতে পারে না।

কার নিচে নামার কথা ভাবছি আমি? দীপ নিজে নিজেকে প্রশ্ন করল। ও নিচে নামলে আমি কি উপরে আছি? কীভাবে? ওর হয়তো জীবনের তাড়া ছিল। কিন্তু আমার? আমার বউ আছে, বাচ্চা আছে। তারপরেও...। খুব ইচ্ছা করছিলো ওর মুখটা দেখতে। আলতো করে হাতের উপর ভর দিয়ে অবন্তির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল দীপ। এসি ছাড়া আছে তারপরেও অবন্তির ক্লান্ত মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দেখতে খুব মায়াবী লাগছে। দীপের হঠাৎ করেই ইচ্ছে হল ওকে একটা চুমো খাওয়ার। কিন্তু কেমন ভয় ভয় করছে। কই রাতে তো এমন হয় নি? নিজের থেকেই উত্তর পেয়ে গেলো দীপ, রাতেরটা ছিল কামনা আর এখনকারটা ভালোবাসা।

সকাল হয়েছে। শেষ পর্যন্ত চুমো খাওয়ার সাহস করে উঠতে পারে নি দীপ। অবন্তি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। টাকা নেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে অবন্তি সংকোচ আজও কেটে উঠতে পারে নি। আজ আরো সেটা তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। আশে পাশে দীপকে দেখাও যাচ্ছে না।

অবন্তি... দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে দীপের ডাক। অবন্তি চমকে উঠল। ভেবেছিলো চিন্তে যখন পারেনি তখন আর নিজের থেকে পরিচয় দিবে না। টাকাটা নিয়ে চলে যাবে। এখন কী করবে সে? এক মিনিট ভাবল। তারপর কণ্ঠে যতটা ঘৃণা দেওয়া সম্ভব দিয়ে বলল, চিন্তে পেরোছো তাহলে? তারপরেই কী ভেবে নিজেকে শোধরালো, কেমন আছো দীপ?

ভাল।
শুনেছি তুমি বিয়ে করেছো, তোমার বউকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল।
দেখবে? এইতো ছবি।
এইটা কে, তোমার ছেলে?
হ্যাঁ।
কী নাম ওর ?
আরিয়ান।
আচ্ছা ... না থাক।
বলো সমস্যা নাই।
তোমার বউতো সুন্দর। তারপরেও কেন অন্য মেয়ে খোঁজো ?

জানিনা, আমি তৃপ্ত হয় না ওর কাছে। এটা হবে না, ওটা হবে না। বড্ড কুল, বড্ড বাঙ্গালিপনা। আমার ভালো লাগে না।

উত্তর শুনে চমকে উঠে অবন্তি। রাতের কথা মনে পড়ে। বিশাল একটা ধাক্কা লাগলো ওর, ও কখনো কারো বউ হতে পারবে না।

আচ্ছা চলি।
টাকা নেবে না ?
হ্যাঁ, ওটা আমার পেশা। নির্লপ্তের মতো টাকা নিয়ে ব্যাগে রাখলো অবন্তি।

চলি? বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো অবন্তি। একটু যেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দীপের চোখের দিকে
চোখ রাখলো। সাপের মত ঠাণ্ডা দৃষ্টি যেন দীপকে ছোবল দেবে এখনি। একটু সময় নিয়ে বললো, কী অদ্ভুত ...

দীপ বললো, কী ?

এই সমাজ। একবার নিপীড়িত হলে তাঁকে ভালোবাসা যায় না, তাঁর সাথে সংসার করা যায় না কিন্তু প্রতি রাতে যে মেয়েটা নিপীড়িত হয় তাকে ঘরে নিয়ে এসে কামনা মেটানো যায়। বউয়ের বাঙ্গালিপনা ভালো লাগে না। আবার যখন বিয়ে করতে যাবে তখন শুদ্ধ মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবে না। হা হা হা, ঘৃণার হাসি হেসে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো অবন্তি।

আর বোবা শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো দীপ।

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭