ইনসাইড থট

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হোক বিতর্ক মুক্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 15/11/2020


Thumbnail

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছি। সেখানে কতটুকু আমরা স্বার্থ চিন্তাকে বাদ দিতে পেরেছি জানিনা। তবে আগামীতে যাতে কোনো বিড়ম্বনা না থাকে সেটা ঠিক করবার সুযোগ আজ বোধহয় হয়েছে। অন্তত এই কোভিড -১৯ মহামারীর সময়ে আমরা যেন সহানুভূতিকে গুরুত্ব দিতে পারি।

আমরা আসলে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কি দেখি? সেখানে নম্বরের ভিত্তে ভর্তি হতে দেখি।  কিন্তু আমাদের দেশে পরীক্ষায় নকল একটি সমস্যা।  এই সমস্যাকে মোকাবেলা করা কঠিন কাজ নয়।  কিন্তু সেটা কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না।  নকলের সঙ্গে প্রশ্ন ফাঁস আরেকটি সমস্যা।  এভাবে সমস্যা আবিষ্কার করলে হাজারো সমস্যার তালিকা আমরা করতে পারি।

এখন একটি সমস্যা আমরা দেখতে পারছি যেটি হলো অহংবোধের সমস্যা।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একটি কমিটিতে প্রস্তাব করেছে যে ভর্তি পরীক্ষা হবে তিনটি এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল ব্যবহার করতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও জানিয়েছে তারা এবার বিভাগীয় শহরে ভর্তিপরীক্ষার আয়োজন করবে।  যদি এরকম একটি ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করতে পারে তবে শিক্ষাথীর্দের ও অভিভাববকদের যে কষ্ট সেটা অনেক কমে আসবে।  মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবেদন ও সরকারের দায় পূরণ হবে।

এখন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।  এবং প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে।  সুতরাং, ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা মিলে একটি আদর্শ ভর্তি নীতিমালা তৈরী করতে পারে যেটি সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য হতে পারে।  এখানে মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে কাজ করতে পারে। আর এবার যেহেতু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়নি সেহেতু ভর্তি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

আমরা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে SAT , GMAT , GRE , টোয়েফল , IELTS  পরীক্ষা নিয়ে ভর্তি করতে দেখি।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো তেমনি একটি পরীক্ষার কথা এবার ভাবছে।  তারা আভাস দিয়েছেন যেহেতু তিনটি ধারায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়, সেই তিনটি ধারায় ভর্তি পরীক্ষা হবে।  ভর্তি পরীক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে তারা কি শিখেছে সেটার পরিমাপ- তবে পরীক্ষার বিষয় হবে ওই উচ্চ  মাধ্যমিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে।  সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব খুবই আশাব্যাঞ্জক। 

এখন প্রয়োজন আমাদের অহং বোধের প্রশমন।  কিভাবে এই পরীক্ষা আয়োজন করলে প্রতিটি  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা বজায় থাকে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যায়।  আমার মতে, এরকম পরীক্ষা কমিটিতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে রাখা যায়।  হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদের দায়িত্ব নিতে পারে , প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়  বিজ্ঞানের দায়িত্ব নিতে পারে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্য অনুষদের দায়িত্ব নিতে পারে।  এভাবে আগামী বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের দায়িত্ব, শেরেবাংলা বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্য অনুষদের দায়িত্ব , এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদের দায়িত্ব পেতে পারে।  এভাবে যাতে প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কোননা কোনোভাবে নিজেদেরকে ভর্তি পরীক্ষায় সম্পর্কযুক্ত করতে পারে।  শিক্ষকরা যাতে তাদের গবেষণা ও শিক্ষকতা করতে পারেন সেজন্য ব্যবস্থার উন্নয়ন করা যেতে পারে। 

সমালোচকরা মনে করেন এখন ভর্তিপরীক্ষা শিক্ষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের মাধ্যম সুতরাং তাদের আয় যাতে কোনোভাবে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেদিকে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।  আমরা লক্ষ্য করেছি ভারত , পাকিস্তান , শ্রীলংকা শিক্ষকদের অনেক বেতন দিয়ে থাকে।  বাংলাদেশ এরইমাঝে ওই দেশগুলিকে বিভিন্ন সূচকে অতিক্রম করেছে।  সুতরাং , শিক্ষকরা উচ্চ স্কেল বেতন পেতে পারেন। 

একবার একটি সংবাদ দেখেছিলাম - সাবেক আমলা ও শিক্ষক জনাব ফরাস উদ্দিন পে -স্কেল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলছেন - ব্রিটিশ আমলেও নাকি সরকারি আমলারা শিক্ষকদের থেকে বেশি বেতন পেতেন। সেজন্য এখনও শিক্ষকরা আমলাদের থেকে কম বেতন পাবেন।!?  জনগণ যদি হয় আমলাদের ভাবনার ও সেবার বিষয় তবে তারা সকলকে দিয়েই না নিজেদের কথা ভাববেন।  কিন্তু জনাব ফরাস উদ্দিনের কথায় আগে আমলাদের ভাগ রেখে অন্যদেরকে দিতে হবে নীতিটি কি সেই কলোনিয়াল শোষণের নীতির পর্যায় পড়ে না ?

আজ আমলারা যেভাবে সমালোচনার মুখে , যেভাবে তারা প্রতিরোধের মুখে তাতে একটি বিপদ আমরা দেখতে পারছি।  সেই বিপদ কারো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।  রাজনীতিবিদরা বলছেন সরকার আমলা নির্ভর।  এবং এটি আরো বিস্তৃত করে বলা হয় আমলা ও পুলিশ নির্ভর।  আর সেজন্য প্রচন্ড প্রতিবাদ দেখেছি যখন সেনা অফিসারকে প্রদীপ -লিয়াকতেরা হত্যা করেছে। এটি একটি বিপদ সংকেত !

একসময় সেনাশাসন নাগরিকদেরকে এমন পীড়া দিয়েছে যে তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি অনেক কমে গেছে।  প্রিয় সহকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেবে দেখা প্রয়োজন ভর্তি পরীক্ষার  বিষয়ে সমাজ কি ভাবছে।  যদি অহং বোধ ও টাকার বিষয় বড়ো করে দেখেন- জনতা তাহলে শিক্ষকদেরকে আমলাদের মত অবহেলা করবে।  এবং শিক্ষকদের মর্যাদা ওই তৃতীয় গ্রেড থেকে যাবে আরো কয়েক যুগ। 

শিক্ষকদের মর্যাদা যাতে সবার উপরে থাকে- সেটা বিবেচনায় নেয়া আমাদের সকলের মনযোগ দেয়া প্রয়োজন।  শিক্ষক যারা হন তারা সবচে মেধাবী , পরিশ্রমী ও ত্যাগী।  এজন্য শিক্ষকের মর্যাদা চিরায়ত ভাবে শীর্ষে।  বেতন গ্রেড দিয়ে তাদের বিবেচনা বাংলাদেশের আমলারা হয়তো করতে পারেন।  কিন্তু শিক্ষক- সচিব , জেনারেল , প্রধানমন্ত্রী , রাষ্ট্রপতি , বিচারপতিরও শিক্ষক।  শিক্ষক সেজন্য সবার উপরে।  সেই মর্যাদার জায়গাটি ভর্তি পরীক্ষার কারণে প্রশ্নর মুখে পড়ছে।  যদি প্রিয় শিক্ষকরা একটু ভেবে দেখেন ?

আগে একটি উপায় ছিল - কলেজ গুলো থেকে ভালো ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতো। তেমন সিস্টেম আমরা আবার ভাবতে পারি কি? সে ক্ষেত্রে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে খারাপ করবে তাদেরকে কলেজ পাঠিয়ে দেয়া হবে। এখনতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি মানে সেকেন্ড ক্লাস সুনিচ্চিত। ফলে মান কোথায় নেমেছে সেটা  আমরা জানি। সুতরাং, কেবল ভর্তির সময় কঠোর বাছাই করেও কিন্তু শিক্ষার মান এবং ন্যায় নিচ্চিত করতে পারছি না।  আমাদের মান সংকট কিভাবে সমাধান করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা যায় কি ?

আমার জানা মতে, অনেক অন্যায়ের ভার সমাজ বহন করে চলেছে। আমি কিংবা আমার সহকর্মী শিক্ষকরা সেই অন্যায়ের ফাঁদে পড়বো কেন? সক্রেটিস জীবন দিয়ে শিক্ষকের মর্যাদা রেখে গেছেন।  হজরত মুহাম্মদ (সঃ ) ছিলেন একজন শিক্ষক।  ঈসা আলাহিয়াসালাম (যিশু)ও  একজন শিক্ষক।  তাঁদের জীবন ছিল সংগ্রামের। 

শিক্ষার্থীদের কষ্ট না দিয়ে আসুন আমরা সহজ পদ্ধতি অনুসন্ধান করি যাতে মানুষ সুখী থাকে।    Utilitarianism, যেটি John Stuart Mill  ১৮৬৩ সনে প্রকাশ করেছেন -সেখানে তিনি বলেছেন –“It is better to be a human being dissatisfied than a pig satisfied; better to be Socrates dissatisfied than a fool satisfied. And if the fool, or the pig, is of a different opinion, it is only because they only know their own side of the question.”

শিক্ষকরা সর্বোচ মর্যাদার মানুষ বলেই রাজা তার সন্তানকে শিক্ষকের কাছে পাঠান। সুতরাং, সেই চিরায়ত শিক্ষকের ইমেজকে ধরে রাখতে ভর্তি পরীক্ষা হোক বিতর্ক মুক্ত। আমরা যেন সুখী শুকুর না হয়ে অসুখী সক্রেটিস হয়ে বাঁচতে পারি- কামনা কি সঠিক নয়?

আমলা -সচিব - সেনা-পুলিশ ভেবেছেন রাজনীতিবিদেরকে খুশি করলে মেওয়া পাওয়া যাবে। কিন্তু বিনিময়ে ওনারা কি পাচ্ছেন সেটা তো দেখা গেছে। আমাদের শিক্ষকদের একটি অংশও রাজনীতিবিদের কাছে ছুটে যান। বিনিময়ে একটি পদ!

আমি জানি ও বিশ্বাস করি   শিক্ষকরা অধিকাংশ পদের জন্য শিক্ষক নন।  শিক্ষক হয়েছেন আত্মমর্যাদা বোধ থেকে।  শিক্ষক যে স্বাধীনতার স্বপ্নের নৌকায় চড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন , সেই বঙ্গবন্ধু আজ নেই।  ঘাতকের বুলেটে বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন। তাই গভীর রাতেও  নারী শিক্ষক গ্রেফতার হন। ১/১১ র সময়ও হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুরা পৃথিবীতে আসেন হাজার বছর কিংবা লক্ষ বছর অপেক্ষার পরে। প্রিয় শিক্ষক আমাদের আরও হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে - যেদিন আরেক বঙ্গবন্ধু আসবেন - আপনাদেরকে আবার জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন , বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আপনাদেরকে নির্বাচন করবেন - তিনি একজন বরেণ্য অধ্যাপককে ফোন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার আমন্ত্রণ জানাবেন।  সেই স্বর্নালী দিনের অপেক্ষায় আসুন ভর্তি পরীক্ষার বিতর্কের ইতি টানি।

বরেণ্য শিক্ষক হীরের মতো। যার নিজের দ্যুতি আছে। সে নক্ষত্রের মতো যে কিনা সমাজকে পথ বাতলে দেয়। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয় রাজপ্রাসাদ থেকে আলাদা। রাজপ্রাসাদের দিকে শিক্ষকের ছোটা মানায় না। আজ বিশ্ববিদ্যালয় নাকি হয়েছে পিএইচডি ফ্যাক্টরি! এই ভার বহনের দায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ধার সবচে জরুরি কাজ প্রিয় শিক্ষক। 

 

লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।  



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭