ইনসাইড আর্টিকেল

ম্যারাডোনা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখতেন কি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 26/11/2020


Thumbnail

মাঠে ফুটবল নিয়ে জাদু দেখানো, ড্রাগআউটে বা গ্যালারীতে আবেগী ম্যারাডোনার মাদক, ছন্নছাড়া জীবনযাপন ও বোহেমিয়ান জীবন যাত্রা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে ম্যারাডোনার বিপ্লবী সত্ত্বা। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পতাকাবাহী ম্যারাডোনাকে খুব কম মানুষই চেনেন।  

বিপ্লবী চে’র ভক্ত ম্যারাডোনার বন্ধু তালিকার প্রথম দিকেই ছিলেন কিউবা ও ল্যাটিন আমেরিকার বামপন্থী নেতা ও রাষ্ট্রনায়কগণ। 

যে পায়ের জাদুতে পুরো দুনিয়ায় তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন সেই পায়েই কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ট্যাটু করে রেখেছিলেন ম্যারাডোনা। হাতে করেছিলেন বিশ্বজনীন বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা চে গেভেরার ট্যাটু। সমাজতান্ত্রিক সমর্থন থেকেই চে ও কাস্ত্রোর উল্কি এঁকে ধনতান্ত্রিক দুনিয়াকে কটাক্ষ করে গিয়েছিলেন তিনি।

আর্জেন্টিনার ছেলে ম্যারাডোনার স্বপ্নের পুরুষ ছিলেন তারই দেশের কিংবদন্তি বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা। শৈশব থেকেই ম্যারাডোনা ছিলেন চে গুয়েভারার খাঁটি সৈনিক। ম্যারাডোনা ছিলেন লাতিন আমেরিকার বাম আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক। সেই পথ ধরেই কাস্ত্রোর অনুরাগী হন তিনি। ১৯৮৬ সালে প্রথমবার কিউবা গিয়ে বিপ্লবী কাস্ত্রোর সঙ্গে পরিচয় হয় ম্যারাডোনার । তার পর অনেকবার কিউবা গিয়েছেন তিনি। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে কাস্ত্রোকে ১০ নম্বর জার্সি উপহারও দিয়েছেন ম্যারাডোনা। ভেনেজুয়েলার বিপ্লবী নেতা হুগো চাভেজেরও অনুসারী ছিলেন তিনি।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রকাশ্য সমালোচক ছিলেন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় ম্যারাডোনা।ক্যারিয়িবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ পেরিয়ে কিউবা ও আর্জেন্টিনা ধনতান্ত্রিক আমেরিকার চক্ষুশূল দুটি দেশ। তবে কিউবা একেবারেই কড়া কমিউনিস্ট শাসনের ঘেরাটোপে সেখানে বারবার সিআইএ ষড়যন্ত্র পরাজিত হয়েছে। আর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা বারবার সিআইএ ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সেদেশেই একাধিকবার বামপন্থীরা সরকার গড়েছেন।

ম্যারাডোনার জীবনে সমালোচনা ও বিতর্কের সংখ্যাও কম নয়। মাদকাসক্ত হয়েছিলেন তিনি। যদিও অভিযোগ আছে, তারএই আসক্তির পেছনে সিআইএ ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল। এমনকি তার বিস্ময়কর প্রতিভা নষ্ট করার পেছনে ছিল পুঁজিবাদী ব্যাস্থা। তারাই তার হাতে ড্রাগ তুলে দিয়েছিলো। কিন্তু সব বিতর্ক সরিয়ে ম্যারাডোনা বারবার মাঠে এসেছিলেন।

এরপরেও মাদকের কারণে অনেকবারই নিরাময় কেন্দ্রে ফিরতে হয়েছিলো তাকে। জীবনের একটা সময় পৃথিবীর অনেক দেশে চিকিৎসা করেও যখন সুস্থ হননি। তখন কিউবায় চিকিৎসায় করিয়ে ড্রাগ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন তিনি। এসময় কাস্ত্রো তাকে সাহায্য করেছিলেন। কাস্ত্রো শুধু ম্যারাডোনার বন্ধুই ছিলেন না তার দাতাও ছিলেন। কিউবার চিকিৎসা ব্যবস্থা যে অনেক উন্নত তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না।

বাণিজ্যিক দাপটে খেলাধুলার জগতও এখন আঁটকে আছে ঘেরাটোপের মধ্যে। একারণেই ক্রীড়া তারকারা কোন রাজনৈতিক বিষয়ে মত জানাতে দ্বিধা দন্দে পড়েন। তবে ম্যারাডোনা এসবের থোড়াই কেয়ার করতেন। চিন্তার জায়গায় ছিলেন তিনি স্পষ্টবাদী। রাজনৈতিক মতাদর্শ গোপন রাখেননি। বাণিজ্যিক ও সাম্রাজ্যবাদ মোড়লদের চোখ রাঙানিকে তুড়ি মেরে ফিদেলের রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রচার করতেন তিনি।

কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরাই দিনদিন ধনী হয়েছে। ধনী হওয়ার সুযোগ আমারও ছিলো। আমি সুযোগ নিইনি। কারণ তা করতে গেলে আমাকে গরিবের পেটে লাথি মেরে তাদের কাছ থেকে চুরি করতে হত।’

আর্জেন্টিনা, কিউবা, ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিলের মতো দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো নানা সমস্যা ও দারিদ্রতায় জর্জরিত। ম্যারাডনার মতে, প্রথম বিশ্বের ধনী দেশগুলিই এই দীনতার জন্য দায়ী। তার অভিযোগ ছিল পোপ থেকে শুরু করে সব দেশের রাজনীতিবিদেরা কেউই গরিবের পক্ষে কথা বলেন না। বার্লিনের প্রাচীর ধ্বংসের পরে সারা পৃথিবীতে যা হারে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে তা দেখার কেউ ছিলো বলে অনেক আক্ষেপ ছিল ম্যারাডনার।

নিজের বাণিজ্যিক দাম কমে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করেতেন না ম্যারাডোনা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিবাদস্বরূপ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কোনোদিন ইংরেজি বলবেন না। এরপর থেকে তিনি আর কোনোদিন ইংরেজিতে বলেছে বলে শুনা যায়নি।যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ম্যারাডোনার সম্পর্ক ভালো ছিল না। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে মাদক গ্রহণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তাকে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই আমলে  যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে সাবেক স্ত্রীর মামলা মোকাবিলার জন্য দেশটিতে যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিলো ম্যারাডোনার। তখন যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য ভিসার আবেদন করেছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবল কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কিন্তু ভিসা আবেদনের সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনার কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে ম্যারাডোনার জানান,ট্রাম্পকে তার কাছে তুচ্ছ পুতুলের মত মনে হয়। টিভিতে ট্রাম্পকে দেখলেই তিনি চ্যালেন পাল্টে ফেলেন।ট্রাম্পকে অসম্মান করে কথা বলার জন্য তখন তাকে ভিসা দেওয়া হয়নি।

পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে গেছেন ম্যারাডোনা। বন্ধু কাস্ত্রোর সান্নিধ্যে ক্রমশ পুঁজিবাদি শাসকের বিরুদ্ধে আরও প্রতিবাদি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মদতে চলা কিউবার সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সরকার গড়ার লক্ষে কাস্ত্রোর সহযোদ্ধা ছিলেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা-কাস্ত্রোর সম্পর্কটা ছিল আত্মিক ও মতাদর্শিক। যদিও তিনি প্রকাশ্যে নিজেকে বামপন্থী বলেননি। কিউবা ছিল তার দ্বিতীয় দেশ। সমাজতন্ত্র বনাম ধনতন্ত্র। এই লড়ইয়ের এক অধিনায়ক কাস্ত্রো আর অপরজন ম্যারাডোনা। সহযোদ্ধা। ২০১৬ সাল ও ২০২০ সাল। কিউবা ও আর্জেন্টিনা। একই দিনেই চলে গেলেন দুই ‘কমরেড’।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭