ইনসাইড আর্টিকেল

কাগজ নিয়ে সাজিদের স্বপ্নযাত্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/08/2017


Thumbnail

প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে রেঁস্তোরায় খেতে গিয়ে যদি দেখেন তেল চিটচিটে প্লেট, তখন কেমন লাগে? অথবা প্রচন্ড চা-কফির তেষ্টা নিয়ে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে যদি কালশিটে দাগ পড়া কাপের দেখা মেলে তাহলে কি আর খেতে ইচ্ছে করে? নিমিষেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা উবে যায়।তবে এর বদলে যদি মেলে কাগজের তৈরি সুদৃশ্য কাপ-প্লেট! তাহলে তো ধোঁয়া ওঠা কাপে তৃপ্তির চুমুক দেওয়াই যায়।তবে এখনো দেশের সীমিত সংখ্যক দোকানেই এমন কাপ-প্লেট চোখে পড়ে। তার বদলে আজকাল রাস্তার পাশের দোকান বা রেস্টুরেন্টে প্লাস্টিকের কাপ প্লেটের ব্যবহারই বেশি দেখা যায় ।অথচ আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য এগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।রাজধানীজুড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনেও বড় কারণ এই প্লাস্টিক ও পলিথিন। একথা আমরা ক’জনই বা ভাবি? তবে ব্যাতিক্রমী কেউ কেউ তো আছেনই, যারা গড্ডালিকায় গা না ভাসিয়ে স্বপ্ন দেখেন একটি পরিবেশ বান্ধব শহরের। ভাবেন দুষণমুক্ত প্রকৃতি নিয়ে। প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে পারলে ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশ দূষণের পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে- এমন চিন্তা থেকেই বিকল্প পণ্য হিসেবে কাগজের কাপ-প্লেট তৈরি করছেন কাজী সাজিদুর রহমান নামে এক তরুণ উদ্যোক্তা । স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি এড়াতে আশার প্রদীপ হাতে এগিয়ে চলছেন তিনি । প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে শিক্ষিত ও সচেতন অনেকেই কাগজের কাপ ও প্লেট ব্যবহার শুরু করছেন। অফিস তো বটেই, অনেকের রান্নাঘরেও জায়গা করে নিয়েছে এই কাপ-প্লেট।

পেছনের গল্প…

খুলনা ব্রাদার্সের হয়ে ফুটবল খেলতেন সাজিদ। খেলতেন ক্রিকেটও।  ১৯৯৭ সালে ঢাকা এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। ছাত্র অবস্থায়ই এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করেন।  চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময় গড়ে তুললেন কাজী করপোরেশন লিমিটেড। বৈদ্যুতিক মিটার, সুইচ গিয়ারসহ আরো কিছু পণ্য আনতে শুরু করেন বিদেশ থেকে। ২০০৩ সালে প্লাস্টিকের সিল আমদানির জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দরপত্রের কাজটা পেয়ে ১০ লাখ পিস সিল সরবরাহ করেছিলেন সাজিদ।

চিন্তার শুরু….

হাতে কিছু টাকা জমিয়ে ২০১০ সালে মাকে নিয়ে হজে যান সাজিদ। একদিন মসজিদে নববীতে মাগরিবের নামাজ পড়তে যান। সেদিন রোজাও রেখেছিলেন। ইফতারের সময় সৌদি এক ভদ্রলোক তাঁকে একটা পেপার কাপে কফি আরেকটা কাপে কিছু খেজুর দেন। কাপ দুটি দেখতে খুবই আকর্ষণীয় ছিল। সাজিদ কফি শেষ করলেন,খেজুর শেষ করতে পারলেন না। রাতে ক্ষিদে পেলে মনে পড়ে খেজুরের কথা। দেখেন পাঞ্জাবীর পকেটে অক্ষতই আছে খেজুরের কাপটি। আর তখনই তাঁর মাথায় আসে চমৎকার এই কাপ তৈরির কথা।  স্মার্টফোনে ‘পেপার কাপ’  লিখে গুগলে সার্চ দিলেন। সেখানে  ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট ইকো ফ্রেন্ডলি এবং হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফুড গ্রেড। ’ এ দুটি বাক্য তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। ভাবেন, দেশের জন্য কি এমন কিছু করতে পারি? যা বাঁচাবে আমাদের পরিবেশকে। নভেম্বরের ২১ তারিখ দেশে ফিরে আসেন।বেশ কিছু শেয়ার ছিল তাঁর বিও অ্যাকাউন্টে। দুই দিন পরই সেগুলো বিক্রি করে দেন। সাজিদের মাথায় তখন কেবলই পেপার কাপ। আমদানি করে ব্যবসা নয়, দেশে নিজের কারখানায় উৎপাদন করতে চান। বিষয়টি নিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করলেন। খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, বিশ্ববাজারে মালয়েশিয়ার মালেক্স কোম্পানির খুব নামডাক। পেপার কাপ নিয়ে হাতে-কলমে শেখার জন্য ২০১১ সালে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমালেন সাজিদ। সেখান থেকে চীন। এভাবে দুই বছর ধরে নিজেকে তৈরি করেন তিনি।

 

স্বপ্নযাত্রা….

দেশে ফিরে পেপার কাপের মার্কেট অ্যানালাইসিস শুরু করেন সাজিদ। দেখলেন বাংলদেশে এর বাজারটা খুব একটা বড় না। তবে চেষ্টা করলে দাঁড় করানো যাবে। এরপর ব্যবসা শুরুর বিষয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। কারখানা ফ্লোর ছাড়াই ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মেশিন আমদানির জন্য এলসি খুলে ফেললেন।করলেন ট্রেড লাইসেন্সও। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ভাড়া বেশি হওয়ায় একটু ভিতরে এক হাজার ২০০ বর্গফুটের একটা ঘরও ভাড়া নেন। দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়ে তাঁদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে কারখানাটি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন। নাম দেন কাজী পেপার কাপ ইন্ডাস্ট্রি-কেপিসি।প্রতিপাদ্য ‘লেট দি এনভায়রনমেন্ট লিভ, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু লিভ’। এরই মধ্যে কোম্পানির প্রোফাইল তৈরি করে জমা দিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। প্রোফাইল দেখে ৩০ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করল ব্যাংক। হাতে ছিল আরও ১০ লাখ। সব মিলিয়ে পুঁজি হলো ৪০ লাখ । এই ব্যবসার জন্য এটা পর্যাপ্ত না হলেও মনের জোরে কাজে নেমে পড়লেন। যেদিন প্রথম মেশিন দেশে আসে, সেদিন কোম্পানিতে তিনজন কর্মচারী নিয়োগ দেন। এনিয়েই এপ্রিল মাসে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে পেপার কাপ উৎপাদন শুরু করেন। প্রথম দিন প্রোডাকশনের কথা মনে করে সাজিদ বলেন, ‘সেদিন পুরো রাত জেগে সব তদারকি করছিলাম। মেশিন থেকে একেকটা কাপ নয় যেন আমার স্বপ্ন মূর্ত হয়ে বের হচ্ছিল। ‘২০১২ সালের জুন মাসে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসে কেপিসি। সেই দিনটির কথা আজও মনে আছে সাজিদের। প্রথম দিনেই কিছু কাপ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। সেদিনই মোটরবাইকের পেছনে পেপার কাপ ও প্লেটের কিছু নমুনা নিয়ে উত্তরায় শেভরনের নিবন্ধিত সরবরাহকারীর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন।  কাপগুলো দেখে সরবরাহকারীর পছন্দ হয়ে গেলো।প্রথমবারেই মাসে দুই লাখ কাপের অর্ডারও মিলল। সাজিদ বললেন, ‘দিনটি ছিল স্বপ্নের মতো। কিছুটা দুঃসাহস নিয়েই প্রথমে তাদের কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের কাপের মান আর নকশার প্রশংসা করেছিলেন তাঁরা।’ এর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে চার-পাঁচটি কোম্পানির অর্ডার আসতে থাকে। পেপসির কাছ থেকেও অর্ডার পান প্রথম মাসেই। আস্তে আস্তে সাজিদের গ্রাহক তালিকায়  যোগ হয় ব্রিটিশ কাউন্সিল, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার, নেসলে, ওয়েস্টিন, সোনারগাঁও হোটেল, ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশন, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, বসুন্ধরা গ্রুপ, অ্যাপোলো হসপিটাল, ইউনাইটেড হসপিটাল, ইস্পাহানি, ডানো, প্রাণ, আকিজ গ্রুপ, বুমারস ক্যাফে, বাংলা কফি, বিএফসি, ইগলুর মতো দেশি-বিদেশি ১৭০টির বেশি প্রতিষ্ঠান। দিনকে দিন এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছে আরো নতুন নতুন নাম।

সাজিদের কাপ-প্লেট…

পেপার কাপ ও প্লেটের কাঁচামাল হিসেবে পলি ইথিলিন কোটেড পেপার বোর্ড ব্যবহার করা হয়। মাটির সংস্পর্শে এলে ২১ দিনের মধ্যে এগুলো জৈব সারে পরিণত হয়। এটি নিজে পঁচে, অন্যকেও পঁচতে সাহায্য করে। কেপিসিতে এখন মূলত ৮০, ১০০, ১২০, ১৩০, ১৫০, ২০০, ২৫০ ও ৩৫০ মিলিলিটার আকৃতির পেপার কাপ এবং ৭, ৯ ও ১০ ইঞ্চির প্লেটের উৎপাদন হচ্ছে।  কেপিসির নিজস্ব নকশা তো আছেই,  গ্রাহকদের মনমতো নকশাও করে দেন তারা। প্র্রতিটি কাপের খরচ পড়ে ৮০ পয়সা থেকে দুই টাকা ৫০ পয়সা। আর প্লেটে এক টাকা ৭০ পয়সা থেকে তিন টাকা ৩০ পয়সা। 

 

চারা থেকে মহীরুহ…

শুরুতে কারখানার আয়তন ছিল এক হাজার ২০০ বর্গফুট। এখন সেটি চার হাজার ২০০ বর্গফুট ছাড়িয়েছে। এত দিন অন্যের জায়গা ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করেছিলেন। এখন পূর্বাচলে জমি কিনেছেন। সম্প্রতি সেখানে কারখানার ভিত্তি প্রস্তরও স্থাপন করেছেন। তিনজন কর্মচারী নিয়ে শুরু করেছিলেন। এখন সাজিদের অধীনে কাজ করছেন মোট ৩২ জন। এর মধ্যে কারখানায় ২২ জন আর অফিসে ১০ জন। আর এখন কারখানায় দৈনিক প্রায় তিন লাখের মতো কাপ-প্লেটের উৎপাদন হচ্ছে। শুধু ব্যবসা নয়, কর্মীদের ভালো-মন্দ নিয়েও ভাবেন সাজিদ। কারখানার পাশেই তাদের থাকার জন্য একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছেন। সেখানে টেলিভিশন আর ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ করে দেন। কর্মীরাও দারুণ খুশি।  সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে  পেয়েছেন এসএমই ফাউন্ডেশনের ‘বর্ষসেরা জাতীয় এসএমই শিল্প উদ্যোক্তা পুরস্কার।

সীমানা পেরিয়ে…

বাংলাদেশে তৈরি পরিবেশবান্ধব কাপ-প্লেট দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেপালে অনুষ্ঠিত নেপাল-বাংলাদেশ যৌথ বাণিজ্য মেলায় অংশ নিয়েছিল সাজিদের কেপিসি। পণ্য দেখে মুগ্ধ হন নেপালের পর্যটনমন্ত্রী। স্টল থেকে কিছু পেপার কাপ নিয়ে মঞ্চের ওপর রাখেন। বক্তব্য দেওয়ার সময় সাজিদকে মঞ্চে ডাকেন তিনি।  বলেন, ‘আপনার প্রোডাক্ট দারুণ লেগেছে। তাই নিয়ে এলাম। আপনি এগুলো আমাকে গিফট করুন। ‘ সাজিদও খুশিমনে সেগুলো নেপালের পর্যটনমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। এই মেলায় বেশ কিছু অর্ডার পান সাজিদ। এখন কেপিসি থেকে দৈনিক দুই-আড়াই লাখ পেপার কাপ নেপালে রপ্তানি হচ্ছে। যাচ্ছে মালয়েশিয়ার বাজারেও।

আছে বাধাও…

সাজিদ জানালেন, পেপার কাপ ও প্লেটের কাঁচামাল আমদানিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের কয়েক গুণ বেশি শুল্ক দিতে হয়। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতও পেপার কাপের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। নেপালে সাড়ে সাত শতাংশ, মিয়ানমারে ৫ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। সেখানে বাংলাদেশে দিতে হয় ৬১ শতাংশ। তিনি বলেন, একটি পেপার কাপের দাম দেড় টাকা। আর প্লাস্টিকের গ্লাসের দাম ৯০ পয়সা। দেড় টাকা থেকে ডিউটি বাদ দিলে এর দাম পড়বে ৯০ পয়সা। অর্থাৎ প্লাস্টিকের সমান দাম। শুল্কই এখন এ ব্যবসার বড় বাধা। দেশে প্রতি মাসে প্লাস্টিকের পণ্যের বাজার পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকা, যা কাগজের বাজারের তুলনায় ১০ ভাগের এক ভাগ মাত্র। তবে একই দামে প্লাস্টিক ও কাগজের কাপ পাওয়া গেলে যে কেউ কাগজেরটাই পছন্দ করবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা…

এটিকে সাজিদ কেবল ব্যবসা হিসেবেনয়, সেবা বলে মনে করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত হবে দেশ। বাঁচবে প্রকৃতি, বিশুদ্ধ হবে পরিবেশ।তাই এ শিল্পকে দেশের মধ্যে একটি বড় শিল্প খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান।

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ

 

 

Save

Save



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭