ইনসাইড বাংলাদেশ

সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ


প্রকাশ: 10/12/2020


Thumbnail

২০১৪ সাল! ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাবার অপেক্ষায় জুলাই মাস। ২৯ জুলায় ঈদ থাকায় ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সাতরশি গ্রামের সোবাহান গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন ঈদের ছুটি কাটাতে। নিজের কষ্টের টাকা জমিয়ে এক বন্ধুর সাথে মিলে ঢাকায় ছোট পরিসরের পোশাক কারখানা শুরু করতে পারায় সোবাহানের মন ছিলো বেশ চনমনে। নিজের গ্রামে আসলে ফেরার সময় মন টানতো না সোবাহানের, ইচ্ছা হতো আরো কয়েকটা দিন গ্রামে কাটিয়ে যাবার। কিন্তু জীবিকার তাগিদে ঈদের ছুটি কাটিয়ে স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তানকে নিয়ে আগস্টের ৪ তারিখ সোবাহান ফিরছিলেন ঢাকায়।

প্রমত্তা পদ্মার বুকে ভেসে চলা পিনাক ৬ এর ভেতরে সোবাহান তখন একমাত্র ছেলের সাথে খেলায় মগ্ন। ঠিক তখনি ঘটলো দুর্ঘটনা, প্রায় আড়াইশো যাত্রী সহ ডুবলো পিনাক ৬। মুহূর্তেই ঝড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগেও জীবন নিয়ে নানান স্বপ্নে বিভোর ৪৯ টি প্রাণ। মৃত্যুর কিছুদিন আগে সোবাহান তার বন্ধুদের বলেছিলো পদ্মা সেতু হবার পরে সে হয়তো প্রতি সপ্তাহেই বাড়ি আসতে পারবে। এটাতো ছিলো পদ্মার বুকে হারিয়ে যাওয়া সোবাহানের গল্প। মাওয়া ফেরিঘাটের ওপাড়ে সাইরেন বাজিয়ে চলা এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে সন্তান প্রসবের তীব্র যন্ত্রণায় কাতর নাসরিনও হয়ত মৃত্যুর আগে ভেবেছিলো ইশ… যদি পদ্মা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছানো যেত। বরিশাল থেকে সবজির ট্রাক নিয়ে ফেরিঘাটের লম্বা লাইনের পেছনে থাকা শরিফুলেরও হয়তো এমন একটা গল্প ছিলো।

পদ্মা সেতু! দেশের দক্ষিণ জনপদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে যার সূচনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে করেছিলেন ২০০১ সালের জুলাই মাসেই। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে বাঙালীর এই স্বপ্ন কিছুদিনের জন্য থমকে গেলেও ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় আসার মাত্র ৬ মাসের মাথায় মন্ত্রীসভায় অনুমোদন পায় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নকশা।


প্রমত্তা পদ্মায় গড়ে ওঠা পদ্মা সেতুতে শুরুর দিকে একটি বড় অর্থায়ন করার কথা ছিল বিশ্বব্যাংক ও কয়েকটি বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার। তখন এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। মোট অংকের ভেতরে বিশ্বব্যাংক একাই অর্থায়ন করতে চেয়েছিল ১২০ কোটি মার্কিন ডলার। বাকি অর্থ এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের জোগান দেওয়ার কথা ছিল। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ায় অন্যান্য বিদেশি দাতাসংস্থাও প্রকল্পটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

শুরুতে এসব দাতা সংস্থা ও বিশ্বব্যাংককে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হলেও পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাংক ও সরকারের মাঝে নানা আলোচনার একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ সহায়তা না নেওয়ার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সরকার। মহান জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মানের ঘোষণা দিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি দেশের মানুষ ও প্রবাসীদের সহযোগিতা করার জন্য আহবান জানালেন। জনগণ সারা দিলো। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের প্রেক্ষিতে শুরু হলো অর্থ সংগ্রহ। এভাবেই শুরু হলো নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ সংগ্রহের কাজ। শেখ হসিনা অনড় রইলেন। বিশ্বব্যাংকের টালবাহানার প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়নের অনুরোধ প্রত্যাহার করে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দিলো সরকার।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর দিনটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। সেদিনই বাংলাদেশের নিজস্ব শক্তিমত্তার আভাস হয়তো কিছুটা হলেও পেয়েছিলো বিশ্ববাসী। এরপরের পথটাও ছোট নয়। সর্বমোট ৪১ টি স্প্যান বিশিষ্ট পদ্মা সেতু নির্মান মোটেই
সহজ কাজ ছিলো না। কারণ উন্মত্তা পদ্মায় বারবারই যেন বাধা আসছিলো। শুরুতে প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি করে পাইল (মাটির গভীরে স্টিলের ভিত্তি বসানো) বসানোর পরিকল্পনা ছিল। যুক্তরাজ্যের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা সংশোধন করে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। ৬.১৫ কিলোমিটারের এই দীর্ঘ সেতুতে বাকি স্প্যানগুলো বসাতে তিন বছর দুই মাস লেগে যায়। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং বন্যার অত্যধিক স্রোত পদ্মা সেতুর কাজে কিছুটা গতি কমিয়ে দিলেও করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির ধকল কাটিয়ে গত ১১ অক্টোবর ৩২তম স্প্যান বসানোর পর অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া যায়। কারিগরি কোনো জটিলতাও তৈরি হয়নি। ফলে, টানা বাকি স্প্যানগুলো বসানো সম্ভব হয়।

অবশেষে আসলো ১০ ডিসেম্বর ২০২০ । যে দিনটি স্বাধীনতার পরে বাঙ্গালীর সবচেয়ে বড় গৌরব আর অর্জনের দিন। শীতের আগমনী হাওয়া লাগতে শুরু করা বাঙলার মানুষ এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছে অনেক কাল। দুপুর ১২.০২ এ যখন ৪১ তম স্প্যানটি ছুঁয়ে যাবার সাথে সাথেই যেন হেসে উঠেছিলো পদ্মার দুইপাড়। কারণ রক্তের দামে কেনা বাঙলার সবচেয়ে বড় স্থাপনাটিও যে কারো দয়ায় আর দানে নয়। নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ আজ গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিলো প্রমত্তা পদ্মার বুকে আকাশের নিচে গর্বের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান ৬.১৫ কিলোমিটার। যার সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত শুধুমাত্রই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭