ইনসাইড আর্টিকেল

বাঙালির বিচক্ষণ বন্ধু

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/12/2020


Thumbnail

১৯৭২ সাল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বঙ্গবন্ধুর চোখে মুখে তখন শুধু বাংলাদেশে ফেরত আসার সপ্ন। ৯ জানুয়ারি লন্ডন ও ভারত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত আসার পথে দিল্লিতে বিশাল নাগরিক সংবর্ধনার মুখোমুখি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘আজ বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র কিন্তু আজ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ পাশাপাশি ভাই ভাই হিসেবে বাস করবে শান্তিপূর্ণভাবে।’ 


সেদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের মিল কেন? বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন- ‘এটা আদর্শের মিল, নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির জন্য মিল। বঙ্গবন্ধুর এ কথা শুনে সেদিন সমবেত জনতা বুঝেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সোনার বাংলা পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর দরকার ছিল অন্যান্য দেশের সহযোগিতা।’  

একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ওই দেশের সম্পর্কের সমীকরণের ওপর। বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু খুব ভালোভাবেই সেটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। 

তাইতো বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় এবং সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান।’

১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ভারত সফর প্রথম সরকারি বিদেশ সফর ছিল। ভারতের রাজভবনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন- ‘আপনি আমার জন্মদিন আগামী ১৭ মার্চ  বাংলাদেশ সফরে আসবেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি চাই সেদিন আপনার সফরের আগেই আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর কথায় সম্মতি জানিয়েছিলেন। ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। 
 
শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্যই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এ দ্রুত সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল।’এতো বড় ঘটনার পরও বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় করে এসেছেন। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে শান্তি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) যোগদান ইত্যাদি ছিল তার বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হওয়ার প্রমাণ।

 ১৯৭২ সালের ১ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন বঙ্গবন্ধু। সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর ও কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্রনীতির আরও একটি বড় উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন দিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী প্রস্তাবের বিপক্ষে ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল। সেদিন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তাছাড়া ক্রেমলিনে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ব্রেজনেভ এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। 

১৯৭৩ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করে। রাষ্ট্র পরিচালনার মাত্র ১ বছর ৪ মাস ১২ দিনের মাথায় ২৩ মে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার প্রদানের জন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদ যে ঘোষণা দেয় তার অন্যতম কারণ ছিল সফল পররাষ্ট্রনীতি ও বিশ্বে শান্তির পক্ষে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন।

বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কমনওয়েলথ অব ন্যাশনস্, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা ও জাতিসংঘ। এ ৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোয় বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

১৯৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। বঙ্গবন্ধু সেদিন বক্তৃতায় বৃহৎ শক্তিবর্গের উদ্দেশ্য বলেছিলেন, ‘হোয়েন এলিফ্যান্ট প্লেসেস, গ্রাস সাফারস...’; তার এ বক্তৃতা উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।

সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ ভিয়েতনামে আমেরিকার বোমাবাজি বন্ধের দাবি জানায়। ২৩ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্যাট্রিস লুলুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকে শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। 

তিনি ৫-৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত চতুর্থ ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ওই সময় তিনি বাদশাহ ফয়সাল, প্রেসিডেন্ট টিটো, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, প্রধানমন্ত্রী তাকেদ্দিন স্লথ প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু ১৮ অক্টোবর সাত দিনের এক সফরে টোকিও গমন করেন। ওই বছর তিনি স্বল্প সময়ের জন্য মালয়েশিয়া সফরেও গিয়েছিলেন।

১৯৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু ইসলামিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য পাকিস্তান গমন করেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু যখন লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণ করেন, তখন রাস্তার দু-পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের জনগণ স্লোগান তুলেছে- ‘জিয়ে মুজিব, জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ ‘মুজিব জিন্দাবাদ, মুজিব জিন্দাবাদ’। 

সেদিন সৌদি বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেছিলেন- ইউর ম্যাজেস্ট্রি, আপনি আমার দেশকে স্বীকৃতি না দিয়েও আমার দেশের মানুষকে হজব্রত পালনের সুযোগ দিয়েছেন বলে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

জাপান সফরকালে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ‘যমুনা সেতু’ নির্মাণে জাপানের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আদায় করে এনেছিলেন; যা আজকে ‘বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু’ নামে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে।

১৯৭৪ সালের শুরুতেই চার দিনের এক সফরে বাংলাদেশে আসেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নরম্যান এরিক কার্ক। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রোজ টিটো ২৯ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন। ফেব্রুয়ারিতে সফরে আসেন ওআইসি মহাসচিব। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। 

১৯৭৪-এর ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান। সেদিন জাতির পিতা জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেদিন ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করেছিলেন।

২৮ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালি ও পাকিস্তানির প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধু চুক্তিটিকে অভিনন্দন জানান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ বাঙালিদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৬৮ জন বাঙালির একটি দল বাংলাদেশে ফিরে আসার মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হয়।

১৯৭৫ সালের ১৯ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরে আসেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফরে আসেন জাপানের যুবরাজ আকিহিতো। একই মাসে নেপালের রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নেপাল যায়। মার্চে ঢাকায় আসেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-এর প্রেসিডেন্ট। দুই দিনের সফরে ১৪ মার্চ ঢাকায় আসেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ। ওই মাসে সিডার প্রেসিডেন্টও ঢাকা সফর করেন। বঙ্গবন্ধু ২৭ এপ্রিল জ্যামাইকা যান কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। বাংলাদেশ ১৯ মে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা এবং ২২ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য পদ লাভ করে। ২৩ জুন বাংলাদেশ বিশ্ব খাদ্য পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়।
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে জুলাই ১৯৭৫, মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০টির মতো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সফরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয়। 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত থাকতেই সৌদি আরব, সুদান, ওমান ও চীন ছাড়া বিশ্বের সব রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা বিশ্বনেতাদের কাছে আমাদের সম্মান শুধু বাড়িয়েছে। একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশকে উনি অল্প কিছু বছরের মধ্যে যেভাবে তুলে ধরেছেন সেটি বিশ্বের মানচিত্রে আজও আজব এক ধাঁধা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭