ইনসাইড আর্টিকেল

কেমন আছে বিউটি বোর্ডিং?


প্রকাশ: 28/12/2020


Thumbnail

‘বঙ্গবন্ধু এখানে এসে বাবাকে বলতেন, প্রহ্লাদ কেমন আছ? আজকে কী রান্না হয়েছে? বঙ্গবন্ধু বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। এখানে প্রায়ই আসতেন, আড্ডা দিতেন। আরও অনেক গুণীজনের আড্ডা ছিল এইখানে।’

বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান কর্ণধার সমর সাহা স্মৃতিচারণ করেই বাংলা ইনসাইডারকে এ কথা বলেন।

পুরান ঢাকার বিউটি  বোর্ডিংয়ের আড্ডাগুলো পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশির দশকে আমাদেরকে শিল্পকে সমৃদ্ধ করে গেছে। এখানেই রচিত হয়েছে অগণিত কালজয়ী কবিতা, উপন্যাস, গল্প, চলচ্চিত্র কিংবা অন্যান্য শিল্পকর্ম। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা, সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যাক্তিদের আড্ডায় সবসময় মুখরিত থাকত বিউটি বোর্ডিং।

রাজধানীর পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের ১ নম্বর শ্রীশচন্দ্র লেনে অবস্থিত বিউটি বোর্ডিং। হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটির আঙিনায় প্রবেশ করার পর যে কোনো মানুষ বিমোহিত হয়ে যাবে এর সৌন্দর্যে। বাড়ির কারুকার্য মুহূর্তেই যে-কাউকে নিয়ে যাবে ১০০ বছর পেছনে।

৪৭ এর দেশভাগের পূর্বে নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের জমিদার বাড়ির ভবনে সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বের হতো `সোনার বাংলা` নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা, সাথে গড়ে ওঠেছিল সেটার ছাপাখানাও। মূলত তখন থেকেই ঐ ভবনটি হয়ে ওঠে শিল্প-সাহিত্যের মানুষদের আনাগোনায় মুখর।
 
দেশভাগের পর `সোনার বাংলা` কার্যালয় স্থানান্তর হয় কলকাতায়, জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসও চলে যান ভারতে। দুই বছর খালি পড়ে থাকে ভবনটি। ১৯৪৯ সালে সেটি ভাড়া নেন মুন্সিগঞ্জের দুই সহোদর নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা। নলিনী মোহন সাহার বড় মেয়ের নাম ছিল বিউটি। তার নামেই তারা গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং।

কালের বিবর্তনে বিউটি বোর্ডিং হারিয়েছে এর জৌলুস। নতুন প্রজন্মের কাছে বিউটি বোর্ডিংয়ের গুরত্ব, তাৎপর্য না থাকলেও এখনো ইতিহাসের স্বাক্ষী অনেকেই আসেন স্মৃতিচারণ করতে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান এখানে বসেই লিখেছিলেন বাংলার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’। ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের পান্ডুলিপির স্বাক্ষীও এই বিউটি বোর্ডিং। ১৯৫৭ সালে কবি ফজল শাহাবুদ্দিন এখান থেকেই প্রকাশ করেন সাহিত্য পত্রিকা ‘কবিকণ্ঠ’। ১৯৫৯ সালে আহমদ ছফার সাহিত্য পত্রিকা ‘স্বদেশ’-এর উত্থানও এই বিউটি বোর্ডিং থেকেই। ১৯৫৭ সাল থেকে ’৬২ সাল পর্যন্ত এখানে বসেই লেখালেখি করতেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।

কবি শামসুর রাহমান এই বিউটি বোর্ডিং নিয়েই লিখেছিলেন, ‘মনে পড়ে একদা যেতাম প্রত্যহ দুবেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই বিউটি বোর্ডিংয়ে পরস্পর মুখ দেখার আশায় আমরা কজন।’

১১ কাঠা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিউটি বোর্ডিং একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনস্থল। এখানে বসেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলন নিয়ে নানা পরিকল্পনা হয়। সেই খবর পেয়েই ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। নারকীয় সেই হামলায় শহীদ হন বিউটি বোর্ডিংয়ের অন্যতম কর্ণধার প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং পুনরায় চালু করেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা আগের মতো না থাকলেও খাবারঘরে এখনো পুরান ঢাকার ভোজনরসিকদের ভিড় থাকে। শুধু পুরান ঢাকাই নয়, রাজধানীর প্রায় সব ভোজনরসিকরা ছুটে আসেন এখানে। ঐতিহ্যকে ধারণ করে আজও এখানে স্টিলের থালায় ও গ্লাসে খাবার-পানি পরিবেশন করা হয়। সকালে নাশতা, দুপুরে ভাত, বিকালে সুস্বাদু লুচি ও রাতেও রয়েছে খাবারের ব্যবস্থা। বিউটি বোর্ডিংয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে কক্ষ রয়েছে ২৫টি। একমাত্র বড় কক্ষের ভাড়া এক হাজার ২০০ টাকা আর সিঙ্গেল কক্ষ ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে।

বিউটি বোর্ডিংয়ের একটি তালিকা থেকে দেখা যায়: শামসুর রাহমান, শহিদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক ছাড়াও এখানে নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন হাসান হাফিজুর রহমান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবি আল মাহমুদ, রণেশ দাসগুপ্ত, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমদ ছফা, হায়াৎ মামুদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দিন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শফিক রেহমান, আসাদ চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সাঁতারু ব্রজেন দাস, কিংবদন্তি কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ও লেখক জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, ভাস্কর নিতুন কুণ্ডু, নায়করাজ রাজ্জাক, টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী, সঙ্গীতজ্ঞ সত্য সাহা, অভিনেতা প্রবীর মিত্র, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, কমরেড আব্দুল মতিন, অলি আহাদদের মতো রাজনীতির তরুণ প্রতিভারাও।

করোনারভাইরাসে ক্ষতিকর প্রভাবে পড়েছে বিউটি বোর্ডিংয়ে। ২৫টি কক্ষের বেশির ভাগই থাকে খালি। আর্থিক সঙ্কট এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত এই বিউটি বোর্ডিং বর্তমানে সংকটময় দিন কাটাচ্ছে।

করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এর ক্ষতিকর প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। অন্যদিকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাবে বিউটি বোর্ডিং হুমকির মুখে রয়েছে বলেও জানান সমর সাহা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই এখন দেশের এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।

বিউটি বোর্ডিংয়ে নেই আড্ডা, নেই গুণীজনের পদচারণা। অজস্র গুণীজনের স্মৃতিবিজড়িত এই বিউটি বোর্ডিং কি হারিয়ে যাবে কালের আবর্তনে? নাকি তরুণ প্রজন্মের মেধাবীরা এই বিউটি বোর্ডিংয়ের পরবর্তী প্রজন্মের স্বাক্ষী হবে!



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭