ইনসাইড আর্টিকেল

কাঠির মাথায় এক টুকরো মিষ্টি মেঘ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 15/01/2021


Thumbnail

কালের পারিবর্তনে বদলেছে অনেককিছুই। মানুষের খাদ্যাভাসে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বদলে গেছে খাবারও। বিশেষ করে ফেরি করে বিক্রি করা খাবারে এসেছে অনেক পরিবর্তন। আধুনিক ফাস্টফুডসহ নানা খাবারের তোড়ে অনেক খাবারের পাশাপাশি হারিয়ে যেতে বসেছে মিষ্টি খাবার হাওয়াই মিঠাই। তবু মাঝে মধ্যে দেখা মেলে কোনো পার্ক, জনজমায়েত অথবা বিভিন্ন মেলায়। হাওয়াই মিঠাই, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি মিঠাইয়ের নাম। তবে এখনো হাওয়াই মিঠাই গ্রামের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। একসময় ‘হাওয়াই মিঠাই’ গ্রামাঞ্চলেই বেশি পাওয়া যেতো। কিন্তু, আধুনিকতার কারণে এটি এখন আর খুব বেশি দেখা যায় না। তবে তা একেবারেও বিলীন হয়ে যায়নি।

হাওয়ার সঙ্গে এই মিঠাই নিমিষে বিলীন হয়ে যায় বলেই এর নাম ‘হাওয়াই মিঠাই’। বানানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখে দিয়ে খেতে হয় এটি। পেট ভরে না এ মিঠাইয়ে, তবে খেতে মিষ্টি। মুখের স্বাদ মেটায় শুধু। দেখতে অনেক বড়সড় মনে হলেও নিমিষেই এটি মুখের ভেতর এসে গলে যায়। বিশেষ করে গ্রামের শিশুরা এই মিঠায়ে বেশি আনন্দ পায়। বড়রাও এর স্বাদ থেকে পিছিয়ে থাকেন না। ক্রয়সাধ্যের মধ্যে থাকায় সবার আগ্রহ থাকে এই মিঠাইয়ের প্রতি। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন মেলা এবং গ্রামের পথে ঘাটে বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে দেখা পাওয়া যায় হাওয়াই মিঠাই ফেরিওয়ালাদের। পিতল বা কাঁসার ঘন্টায় টিং টিং শব্দ তুলে শিশু-কিশোরদের দৃষ্টি কাড়ে তারা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের ঘিরে ধরে শিশু কিশোরের দল এমনকি বৃদ্ধ যুবারাও পিছিয়ে থাকে না কোন অংশে। 

হাওয়াই মিঠাই একপ্রকার মিষ্টি জাতীয় খাদ্য। যা একপ্রকার চকলেটের অনুরুপ। একসময় ২৫ পয়সা থেকে ১ টাকা খরচ করলেই মিলতো কয়েক পিস। যা বর্তমানে দশ টাকা আবার কোথাও কোথাও বিশ টাকায়ও বিক্রি হয়। মাঝে মধ্যে আবার পুরনো ভাঙারি জিনিসেও মিলতো এই হাওয়াই মিঠাই। কাচঘেরা বাক্সে ছোট ছোট গোল হাওয়াই মিঠাই রাখা হতো। মুখে দিলেই হাওয়ার মতো মিলিয়ে যেতো, তবু মুখে যে স্বাদ লেগে থাকতো তার অনুভূতি ছিলো চমৎকার। কাঠির মাথায় যেন এক টুকরো গোলাপি কিংবা সাদা রঙের মেঘ। কোথাও বেড়াতে গেলে প্রায় সব ছোটরা এমনকী বড়রাও এই কাঠির মাথায় এক টুকরো মেঘ খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অনেকে মজা করে হাওয়াই মিঠাইকে বুড়ির মাথার পাকা চুলও বলেন।  বাংলাতে হাওয়াই মিঠাই নামে এই খাবারটি পরিচিত পেলেও, কটন ক্যান্ডি, ফেয়ারি ফ্লস, ক্যান্ডি ফ্লস ও স্পুন সুগার মত বাহারি ইংরেজি নামেও পশ্চিমা দেশ গুলিতে পরিচিত এই হাওয়াই মিঠাই। শুনলে অবাক হবেন, মার্কিনীরা  এই হাওয়াই মিঠায়ের এতই ভক্ত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭ ডিসেম্বর দিনটি ‘জাতীয় কটন ক্যান্ডি ডে’ হিসাবে পালন করে।

চিনি দিয়ে তৈরি এই মজার খাবারটি পথচলা শুরু হয় চৌদ্দশতকে ইটালিতে। সেই সময় ঘরোয়া ভাবেই  চিনির ঘন রস বিশেষ পদ্ধতিতে সুতোর মতো তৈরি করে বানানো হত এই হাওয়াই মিঠাই। চৌদ্দশতক থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত একই ভাবে পথ চলেছে এই মিঠাই। কিন্তু মার্কিন নাগরিক উইলিয়ম মরিসন ও জন সি ওয়ারটন ১৮৯৭ সালে হাওয়াই মিঠাই তৈরির জন্য প্রথম মেশিন আবিষ্কার করেন। এই মেশিনের সাহায্যে চিনির যে সূক্ষ্ম  সুতো তৈরি হত সেগুলো বাতাস লাগার সঙ্গে সঙ্গেই শক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তাড়াতাড়ি খাবারটা তৈরি হয়ে যেতে লাগল। যদিও মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই তখন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ব্যাপকভাবে এই খাবারটির প্রসার বাড়ে ১৯০৪ সালে। সে বছর মরিসন এবং ওয়ারটন মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাজির হলেন সেন্ট লুইসের বিশ্ব মেলায়। অবাক হওয়ার বিষয় হল, মেলার প্রথম দিনই ২৫ সেন্ট করে ৬৮ হাজার ৬৫৫ বাক্স হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয়েছিল, যা ছিল সে সময়ের হিসাবে অনেক বড় একটা অঙ্ক। ক্রমেই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় হাওয়াই মিঠাই। চাহিদা ও জনপ্রিয়তার দেখে এই মজাদার খাবারটি উৎপাদন ও বিপণনে এগিয়ে এল একাধিক কোম্পানি। তাদের মধ্যে বর্তমানে টটসি রোল অফ কানাডা লিঃ, বিশ্বের সর্বাধিক হাওয়াই মিঠাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

ইউরোপ- আমেরিকার জয় করে আমাদের এখানে হাওয়াই মিঠাই তৈরি শুরু হয় এমন কথা বলা বোধ হয় ঠিক হবেনা। কারণ চিনি দিয়ে তৈরি শোনপাপড়ি বহুকাল আগেই  তৈরি হত আমাদের এই বঙ্গে। উন্নত বিশ্বের মত আমাদের দেশে অবশ্য আজও সেভাবে হাওয়াই মিঠাই উৎপাদন এবং সুন্দর প্যাকেজিং করে বিপণন হয় না। আমাদের দেশে মেলা, পার্ক, দর্শনিয় স্থান, শিশুদের বিদ্যালয়ের সামনে কিংবা রাস্তার ফেরী করে বিক্রি করা হয় এই হাওয়াই মিঠাই।

জীবনের অনেক দর্শন তাত্ত্বিক উদাহরনে ব্যবহার করা হয় এই হাওয়াই মিঠাইয়ের নাম। হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আছে অসংখ্য গান, কবিতা ও গুণীজনদের বাণী। 

সরকার স্বপনের লেখা “জীবন হাওয়াই মিঠাই” কবিতার কয়েকটি লাইন এমন

যাপিত জীবনের এক্ষণে শুধু মনে হয়

হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে এতোটা সময়।

প্রশ্ন স্থির আছে, উত্তর কিছু মেলে নাই,

"জীবনটা আদতে কি! রঙিন এক হাওয়াই মিঠাই?”



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭