ইনসাইড আর্টিকেল

অস্তিত্ব বিলীনের পথে মাচু পিচু

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/01/2021


Thumbnail

মাচু পিচু দক্ষিন আমেরিকায় অবস্থিত পেরুর একটি প্রধান নগরী। কেউ কেউ এটিকে সূর্যনগরীও বলেন। স্প্যানিশ ভাষায় এই শব্দটি উচ্চারণ করা হয় মাত্সু পিৎসু। যার অর্থ প্রাচীন চূড়া।

শহরটিতে ১৪০ টি স্থাপনার সবকটিই এখনো টিকে আছে। অনেক প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যার স্বাক্ষর বহন করে এই মাচুপিচু । পেরু ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসাবে বেশ পরিচিত। তাই ধারনা করা হয় সাধারণ সিমেন্টের জোড়া হলে ভূমিকম্পে স্থাপনাগুলো টিকতো না। কিন্তু পাথরের খাঁজে খাঁজে বসিয়ে তৈরি করা বলে মাচুপিচুর এই স্থাপনাগুলো বেশ ভূমিকম্প প্রতিরোধী। এ কারণেই ইনকাদের এই শহর গত ৪০০ বছরে অসংখ্য ভূমিকম্প সহ্য করেও বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে। এটি নির্মাণ করতে প্রয়োগ করা হয়েছিল সমসাময়িক কালের সবথেকে সূক্ষ্ম এবং বিখ্যাত বাস্তুবিদ্যার কৌশল। এখানকার স্থাপনাগুলোর দেয়াল পাথরদ্বারা নির্মিত। মজার বিষয় হল পাথরগুলো একে অপরের সাথে জোড়া দেয়ার জন্য কোন রকম সিমেন্ট ,বালু বা চুন-সুরকির মিশ্রণ ব্যবহৃত হয়নি,তাই ভূমিকম্পেও এর কোনপ্রকার ক্ষতি হয়নি। তাদের এই নির্মাণ কৌশলকে বলা হয় অ্যাশলার। এ কৌশলে ইনকারা বেশ দক্ষ ছিল। এই পদ্ধতিতে পাথরের খন্ড কাটা হত খুব নিখুঁতভাবে। তারপর তাদের খাঁজে খাঁজে বসিয়ে দেয়া হত। ফলে সংযোগকারী সিমেন্টের কোন প্রয়োজন ছিল না। তাদের নির্মিত পাথর এতই সুনিপুণ হতো যে একটা পাতলা ছুরির ফলাও দুই পাথরের মধ্যবর্তি ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করানো কার্যত অসম্ভব ছিল।

এখানে বিভিন্ন স্থাপনার মধ্যে রয়েছে কিছু মন্দিরসহ পবিত্র স্থান, উদ্যান এবং আবাসিক ভবন। মাচু পিচুতে রয়েছে ১০০টিরও বেশি সিঁড়ি। অবাক করা বিষয় হল এই সকল সিঁড়ির মধ্যে কিছু সিঁড়ি নির্মিত হয়েছিল একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরের খণ্ড দিয়ে। এখানে আরও রয়েছে প্রচুর সংখ্যক ঝরনা, যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা ছোট ছোট খালের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত এবং এসব মূলত সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও এই সেচব্যবস্থা ব্যবহার করে একটি পবিত্র ঝরনা থেকে প্রতিটি বাড়িতে পানি সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

তবে এসকল সুবিধা খুব বেশি দিন ভোগ করতে পারেনি ইনকারা। ১০০ বছর পরেই স্প্যানিশরা ইনকা সভ্যতা আক্রমণ করে। এবং ধ্বংস করে ফেলে তাদের বেশির ভাগ শহর। কিন্তু মাচু পিচু শহরটি গুপ্ত স্থানে হওয়ায় তারা এটি খুঁজেই পায়নি! এদিকে মানুষের উপস্থিতি না থাকার কারণে শহরটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কয়েকশ বছর ধরেতো মানুষ এই ঐতিহাসিক শহরটিকে খুঁজেই পায়নি।

২৪ জুলাই, ১৯১১ ইনকা সভ্যতার বিখ্যাত মাচুপিচু শহর আবিষ্কার করে, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিরাম বিংহাম। বিংহাম’ই প্রথম মাচু পিচুকে জনসমক্ষে আনেন তার বই " দ্য লস্ট সিটি অব দ্য ইনকাস"। যদিও হিরাম বিংহামকেই এর আবিষ্কর্তা মনে করা হয়, কিন্তু কোস্কো শহরের গবেষক সিমন ওয়েসবার্ড বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। অনেকে দাবি করেন যে তার আগেই একজন বিদেশী মিশনারি সেখানে পৌঁছেছিলেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আবার অনেকে দাবী করে থাকেন,আগেই মাচুপিচুতে গিয়েছেন এমন কয়েকজন স্থানীয় তাকে এই জায়গার সন্ধান দেন। এক কৃষকের ১১ বছরের ছেলে তাকে রাস্তা দেখিয়ে এই জায়গায় নিয়ে যায়। যদিও হাইরাম বিংহাম কখনই স্থানীয় সেসব লোকদের কথা কোথাও উল্লেখ করেননি। এমনকি এ শহর আবিষ্কারে তাদের কোন রকম কৃতিত্বও তিনি দেন নি। এ শহর আবিষ্কারের পর সেখানে কিছু প্রাচীন মমিও পাওয়া গিয়েছিল। 

১৯১৩ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি তাদের মাসিক ম্যাগাজিনের পুরোটাই মাচু পিচু নিয়ে তৈরী করে। এরপর থেকেই সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়। বর্তমানে এটি পেরুর প্রধান পর্যটন কেন্দ্র এবং গোটা বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত লাভ করেছে। ১৯৮১ সালে মাচু পিচুর আশপাশের মোট ৩২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা ঘোষণা করা হয়।

পেরুর অর্থনীতি অনেকাংশে এখন মাচু পিচুর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়াতে অনেকগুলো বিলাসী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যাতে এর মূল সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে এর অস্তিত্বের উপর হুমকি সৃষ্টি করেছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে প্রায় পুরো শহরটিকে ইনকা আদলে পুনঃনির্মান করা হয়েছে। এর আশেপাশে যাতায়তের সুব্যবস্থা, থাকার জন্যে হোটেল, এসব করতে গিয়ে এর প্রাকৃতিক আসল রূপ এখন হুমকির সম্মুখীন। আশঙ্কার কথা হল, ২০০৮ সালে পৃথিবীর সবচাইতে ১০০ টি বিপন্ন স্থানের তালিকায় মাচু পিচু ইতোমধ্যে চলে এসেছে। কর্তৃপক্ষ এখনো সচেতন না হলে হয়তো আমাদের জীবদ্দশায় আমরা এর মূল অস্তিত্ব পুরোটাই হারিয়ে ফেলা দেখ যেতে পারি। শেষ পর্ব।

প্রথম পর্ব দেখতে এখানে ক্লিক করুন: ‘মাচুপিচু’ হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা যা আজ এক সপ্তাশ্চর্য

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭