ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

নোবেল পুরস্কারে রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 06/09/2017


Thumbnail

‘গত কয়েক বছর ধরে আমি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক আচরণের জন্য নিন্দা জানিয়ে আসছি। আমি অপেক্ষা করছি নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি একই কাজ করুক। সারা বিশ্ব অপেক্ষা করছে, রোহিঙ্গা মুসলিমরাও অপেক্ষা করছে।’ গত ৪ সেপ্টেম্বর নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে এমনই আকুতি জানালেন নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানি তরুণী মালালা ইউসুফজাই। সম্প্রতি মিয়ানমারে সামরিক জান্তা দ্বারা রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও অত্যাচারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দেশটির গণতন্ত্রপন্থী সুচির শান্তিতে নোবেল পাওয়া নিয়ে এ বিষয়টি সবার সামনে উঠে এসেছে। কিছুদিন আগে টুইটারে অন্যতম পুরস্কারজয়ী মালালা, ডেসমন্ড টুটু ও অন্যান্য বিজয়ীরাও সুচির এ বিষয়ে নির্বিকার থাকা এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি বলে দাবি করা নিয়ে নিন্দা জানিয়েছেন।

‘ওবামার সমর্থকরা পর্যন্ত মনে করেন তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার ছিল একটি ভুল। নোবেল পুরস্কার কমিটি যা আশা করে পুরস্কার দিয়েছিলেন তার কিছুই অর্জন হয়নি।’ কথাটি বলেছিলেন নোবেল কমিটির সাবেক সচিব গের লুন্ডেস্টেড। ১৯০১ সাল থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। নোবেল পুরস্কার দেয়ার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল যারা শান্তি রক্ষায় কাজ করছেন এবং বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে অবদান রাখছেন তাদেরকে এই পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্তু আসলেই কি তাই হচ্ছে? অনেকে মনে করছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়ার পেছনে রয়েছে রাজনীতি। যারা নোবেল পুরস্কারের কমিটিতে রয়েছেন সেসব সদস্যদের মধ্যেই এই রাজনীতি রয়েছে বলে দাবি করা হয়।

সবচেয়ে আলোচিত শান্তি পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তি হলেন মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ২০০৯ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু তাঁর সময়েই মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে ইসলামিক স্টেটস বা আইএসের তৎপরতা বাড়ে। সিরিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ বেধে যায়। যার কোনো সমাধানই তিনি করতে পারেননি। নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে ‍মিখাইল গর্বাচেভ, ইতঝাক রবিন, মেনাকেম বেগিন, লে ডাক থো, হেনরি কিসিঞ্জার, জিমি কার্টার, আল গোর, আইপিসিসি ও লিউ জিয়াবাওকে নিয়েও।

ভিয়েতনামের লি ডাক থো ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার নেননি। তিনি জানান, এ ধরনের বুর্জোয়া চিন্তাভাবনা তাঁর জন্য নয় এবং ভিয়েতনামে সত্যিকারভাবে কোনো শান্তি ফিরে আসেনি। অন্যদিকে থোর সঙ্গে পুরস্কার পেয়েছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনিরি কিসিঞ্জার। তিনি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যাননি এবং পুরস্কারের অর্থ দান করে দেন। এর ১৮ মাস পরে দুই ভিয়েতনাম এক হয়ে গেলে পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।

নোবেল পুরস্কার আসলে কীসের ভিত্তিতে এবং কী ধরনের যোগ্যতা যাচাই করে দেয়া হয় তা এখনও জানা যায়নি। নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চাশ বছর পর নোবেল বিজয়ীদের মনোনীত করার পেছনের মানদণ্ড জানানো হয়। নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটির সদস্যদের মনোনয়ন করে নরওয়ের পার্লামেন্ট। তাঁরা নরওয়ের নাগরিক। প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার কমিটিতে একই ব্যক্তি থাকেন না। তাঁরা প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের সরকার, সংসদ সদস্য, আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য, বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আগের বিজয়ীরা এবং নরওয়ের নোবেল কমিটির বর্তমান ও অতীত সদস্যদের কাছে মনোনীত ব্যক্তির নাম আহ্বান করেন। এরপর সদস্যরা সভায় বসে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তকে নোবেল দেন। এই ভোট কমিটির সদস্যরা দিয়ে থাকেন।

ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে জানায়, এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যাঁরা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কিন্তু কখনও পাননি। তাঁদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধি, এলিনর রুজভেল্ট, উ থান্ট, ভাক্লাভ হ্যাভেল, কেন সারো উইওয়া, ফজলে হাসান আবেদ, সারি নুসাইবাহ ও কোরিজেন আকুইনোর নাম উল্লেখ করে তারা। মহাত্মা গান্ধি ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ ও ১৯৪৭ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। কিন্তু একবারও পাননি। গের লুন্ডেস্টেড জানান, ১০৬ বছরের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। ১৯৪৮ সালে গান্ধি মারা গেলে নোবেল কমিটি জানায়, মৃত কোনো ব্যক্তিকে তারা এ পুরস্কার দেয় না। এরপর ১৯৮৯ সালে দালাইলামাকে তারা এ পুরস্কার দেন এবং জানান, গান্ধিকে সম্মান জানিয়ে তারা এ কাজ করেছেন।

লুন্ডেস্টেড কমিটিতে নিয়োগ করা সদস্যদের নিয়েও সমালোচনা করেন। ২০১০ সালে চীনের ভিন্নমতাবলম্বী আন্দোলনকারী লিই জিয়াবাওকে নোবেল পুরস্কার দিতে নিষেধ করেন তৎকালীন নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তারা আশঙ্কা করছিল যে এতে নরওয়ের সঙ্গে হয়তো চীনের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। যদিও নোবেল কমিটি তাঁর অনুরোধ রাখেনি।

নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থর্বজর্ন জাগল্যান্ডকেও নোবেল কমিটির সদস্য হিসেবে নেয়া উচিত হয়নি বলে মনে করেন ‍লুন্ডেস্টেড। একই সঙ্গে নোবেল কমিটির সদস্যরা অধিকাংশ সময় বিভিন্ন মতাদর্শের অধিকারী হন। যা তাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। যেমনটা ছিলেন, কার ক্রিস্টেনসেন। তিনি নোবেল কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে পুরস্কার দেয়া হয়। তিনি ইয়াসিরকে সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করেন।

নোবেল কমিটিরে সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে আসা সাম্প্রতিক বিতর্ক নিয়ে নোবেল কমিটির সাবেক সদস্য গানার স্টালসেট জানান, আসলে আগের বছরে মনোনীতরা শান্তি রক্ষায় কী করেছেন তার ওপর নির্ভর করে পুরস্কার দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যে নীতি গ্রহণ করে থাকি তা হলো কোনো সাধু-সাধ্বীদের পুরস্কার দেয়া হয় না। যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন পুরস্কার দেয়া হয় ও কমিটির কাজও শেষ হয়ে যায়।

অনেক বিশেষজ্ঞরা জানান, নোবেল কমিটিতে বর্তমান সংসদ সদস্যদের রাখার কারণে তাদের সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক হয়ে থাকে। তাই প্রশ্ন থেকে যায় আসলে, বিজয়ীরা কতটা যোগ্য এ পুরস্কার পাওয়ার জন্য।

বাংলা ইনসাইডার/আরএইচবি/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭