ইনসাইড আর্টিকেল

পারস্যের লেডিকেনি বাংলার মিষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 04/02/2021


Thumbnail

যুগ-যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষের রসনা বিলাসের মূল উপকরণ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় স্থান দখল করে আছে মিষ্টি। বাঙালিদের যেকোন অনুষ্ঠান মিষ্টি ছাড়া অপূর্ণ থেকে যায়। কনে দেখতে এলে পাত্রপক্ষের রেকাবি, বরযাত্রী, জামাইষষ্ঠী, থেকে শুরু করে যে কোন শুভ কাজে, পূজা পার্বণ, উৎসবে মিষ্টি ছাড়া অপূর্ণ থেকে যায় সকল ধরনের আয়োজন। এক কথায় মিষ্টি হল বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই সকল প্রকার মিষ্টির মধ্যে ‘লেডিকেনি’ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মিষ্টি।  লেডিকেনি খানিকটা অভিজাত মিষ্টি। ওদের বাড়িতে `ভোজে` লেডিকেনি মিষ্টি খাইয়েছে মানে বেশ জাঁকালো খাওয়াদাওয়া হয়েছে। তাহলে আসুন লেডিকেনি মিষ্টির ইতিহাস জানার আগে জানা যাক লেডিকেনি সম্পর্কে। লেডিকেনির ইতিহাস জানতে হলে চলে যেতে হবে সুদূর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে।

সাল টা ১৮১৭ । প্যারিসে স্টুয়ার্ট অফ ব্যূত নামক এক নোবল পরিবারে জন্ম নিল একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে। আদর করে তার নাম রাখা হল শার্লট স্টুয়ার্ট। পারিবারিক আভিজাত্যের আর আদরের মধ্যে একটু একটু করে বড় হতে লাগল শার্লট স্টুয়ার্ট। সময়ের প্রয়োজনে শার্লটের পরিবার প্যারিস ছেড়ে চলে এলো লন্ডনে, আর এখানে এসেই শার্লটের জীবনে নিল নতুন মোড়।   শার্লট যখন সতেরো বছরের কিশোরী, তখন চব্বিশ বছরের চার্লসের সঙ্গে তার দেখা হয়। চার্লসের বাবা, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিস্টার জর্জ। দেখা থেকে পরিচয়, সেখান থেকে প্রেম। কিন্তু এই ভালোবাসায় বাধা ছিল অনেক। প্রসঙ্গতই শার্লট ও চার্লস যখন তাদের উভয়ের পরিবারে তাদের ভালবাসার কথা জানালো এককথায় নাকচ করে দিল তাদের উভয় পরিবার। গল্পটা কিন্তু এখানে শেষ হয়নি বরং শুরুটা এখান থেকেই। শার্লটের জেদ আর তাদের ভালোবাসার কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানলো দুই পরিবার। বিয়ে হল চার্লস আর শার্লটের। ১৮৩৫ সালে লন্ডনের সেন্ট মার্টিনে।

বিয়ের বেশ কিছুদিন পরে চার্লসের হাতে এল এক অভাবনীয় সুযোগ। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঠিক করল গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির পরে ভারতের গভর্নর জেনারেল হবে চার্লস ক্যানিং। চার্লসও এককথায় রাজি হয়েগেল। এইভাবে চার্লস ক্যানিং ও শার্লট ১৮৫৬ সালে পা রাখলেন ভারতের মাটিতে। ভারতের খুব জনপ্রিয় গভর্নর জেনারেল হয়ে উঠতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু তার ঠিক পরের বছরেই শুরু হল সিপাহী বিদ্রোহ। তার আগেই অবশ্য শার্লটের অনুপ্রেরণায়  চার্লস ক্যানিং শুরু করেছেন ভারতীয় অধিবাসীদের ওপর গবেষণামূলক কাজ। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাঁর প্রসংশনীয় ভূমিকা পরের বছরেই তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ভাইসরয় হিসাবে অধিষ্ঠিত করে।

ততদিনে চার্লস ক্যানিংয়ের মতোই শার্লটও পরিচিত হয়ে গেছেন লেডি ক্যানিং নামে। এখনকার সেলিব্রিটিদের মতোই তখনও লর্ড এন্ড লেডি ক্যানিংয়ের বিবাহিত জীবন নিয়েও আলোচনা কম হত না। বিশেষ করে লেডি ক্যানিং হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয় এক চরিত্র। হাজার হোক, ভাইসরয়ের স্ত্রী বলে কথা। তারওপর তিনি ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর অত্যান্ত সহানুভূতিশীল। সেই সাথে শার্লট ছিল অসাধারণ রূপবতী এবং দক্ষ চিত্রশিল্পী। ফুল ও গাছের প্রতি ছিল তাঁর অসিম ভালোবাসা। ব্যারাকপুরের বাড়িতে তাঁর নিজের হাতে লালিত বাগান ছিল দেখবার মত। লর্ড ক্যানিং যদিও ভারতীয়দের কাছে কিছুটা নিন্দিত হয়েছিলেন, কিন্তু লেডি ক্যানিং হয়ে উঠেছিলেন খুব জনপ্রিয় এক চরিত্র। ভালোই কাটছিল সবকিছু, কিন্তু সুখের দিন বেশিদিন টিকল না। ১৮৬১ সালে দার্জিলিং যেতে গিয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে লেডি ক্যানিং মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন। ব্যারাকপুরে তাঁকে সমাহিত করা হল। পরে সেই সমাধি সরিয়ে আনা হয় কলকাতার সেন্ট জন্স চার্চে। তার পর লর্ড ক্যানিংও ফিরে গেলেন স্বভূমিতে।

লেডি ক্যানিংয়ের মৃত্যুর পর কলকাতায় বেশ কিছুদিন চর্চা হল তাঁর নামের। আর ‘লেডিকেনি’ মিষ্টির ইতিহাসের শুরুটা এখান থেকেই। তাঁর স্মৃতির উদ্যেশ্যে কলকাতার বিখ্যাত ময়রা ভীম চন্দ্র নাগ বানিয়ে ফেললেন নতুন এক মিষ্টি, যার নাম দিলেন `লেডি ক্যানিং`। `বাঙ্গালা` যেমন ইংরেজদের মুখে মুখে বেঙ্গলি হয়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনিই নতুন মিষ্টি `লেডি ক্যানিং` চলতি কথায় অর্থাৎ অপভ্রংশে হয়ে উঠলো `লেডিকেনি`। এইভাবে ভারতের প্রথম ভাইসরয়পত্নীর নাম থেকে গেল বাংলার মিষ্টির মধ্যে। প্রায় সব সরকারি অনুষ্ঠানে একবাক্যে জায়গা পেতে লাগলো লেডিকেনি। এমনকি সেকালের `ভোজবাড়িতেও` একসাথে উচ্চারিত ও পরিবেশিত হত `রসগোল্লা`-লেডিকেনি`। তবে ইতিহাস বিভ্রাট থেকে রেহাই পায়নি এই ‘লেডিকেনি’। যেমন কেউ কেউ বলেন লেডি ক্যানিংয়ের ভারতে আগমনের উপলক্ষে ভীম নাগ একপ্রকার মিষ্টি বানিয়ে সেই মিষ্টির নাম দিয়ে ছিলেন ‘লেডিকেনি’। আবার আরএক মতে, লেডি ক্যানিংয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে লর্ড চার্লস ক্যানিংই অর্ডার দিয়ে ভাজা রসের এক বিশেষ মিষ্টি বানিয়েছিলেন পরবর্তীতে যার নাম দিয়েছিলেন ‘লেডিকেনি’। বিভ্রাট যাই থাকুক লেডি ক্যানিংয়ের নাম যে এই মিষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেকথা একবাক্যে স্বীকার করবেন সকলেই।

লেডিকেনি শুকনো মিষ্টি নয়, বরং রসগোল্লার মতোই রসে ডোবানো। তবে ঘন হলদেটে রস নয়, বরং রসগোল্লার মত পাতলা আর কম মিষ্টির রসে ডোবানো। লেডিকেনির ভেতরে একটা গহ্বর থাকে, যাতে থাকে কিছুটা রস আর একটা এলাচ। এই এলাচ হল লেডিকেনির আসল পরিচয়। তবে এখন উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটা দোকান ছাড়া আর কোথাওই আদি-অকৃত্রিম লেডিকেনি পাওয়া যায় না।

আর এইভাবে প্যারিসের শার্লট মেয়ে লন্ডন হয়ে ভারতে এসে চিরকালের জন্য বন্দি হয়ে থেকে গেল শ্যামবাজার-ভবানীপুরের মিষ্টির দোকানে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭