ইনসাইড থট

কয়েকটি মন খারাপ করা ঘটনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 08/09/2017


Thumbnail

১.
আগস্ট মাস মনে হয় সত্যিই বাংলাদেশে জন্য অশুভ একটা মাস। কীভাবে কীভাবে জানি এই মাসটিতে শুধু মন খারাপ করা ঘটনা ঘটতে থাকে। দু:সময় নিশ্চয়ই এক সময় কেটে যাবে তারপরও যখন ঠিক এই সময়টির ভেতর দিয়ে যেতে হয় তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়।

শুরু হয়েছে বন্যা দিয়ে। বিস্তীর্ন এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেল, মাঠে ঘাটে পানি, বাড়ির ভেতর পানি। আমরা যারা পুরো সময়টা শুকনো মাটিতে কাটিয়েছি তারা নিশ্চয়িই কল্পনাও করতে পানি না পানিতে ডুবে যাওয়া এলাকায় দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা সময় কাটাতে কেমন লাগে। নি:শ্বাস বন্ধ করে বসে আছি কখন বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাবে, দেশের মানুষ আবার জীবন ফিরে পাবে।

শুধু যে নদীর পানি ঢলে বন্যা হয়েছে তা নয়, ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতার কারণে পানিতে ডুবে আছে। মানুষজন সেই পানি ভেঙ্গে যাতায়াত করছে, ধরেই নিয়েছে এটাই জীবন। যারা থাকে তারা গরীব মানুষ, সাধারণ মানুষ, তাই তাঁদের কণ্ঠস্বর খুব বেশি দূরে যেতে পারে না। তারা মেনেই নিয়েছে এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে।

প্রতি বছরই বন্যায় একটা সময় আসে এবং প্রতি বছরই আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে চিন্তা করি কোনো একটি রহস্যময় কারণে আমাদের বাংলা ভাষায় ‘বন্যা শব্দটি কিন্তু নেতিবাচক নয়। যদি এচটা নেতিবাচক শব্দ হতো তাহলে আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা কিন্তু তাঁদের মেয়েদের নাম কখনোই বন্যা রাখতেন না। কখনো কোনো মানুষের নাম খরা, ভূমিকম্প বা ঘূণিঝড় হতে দেখিনি কিন্তু বন্যা নামটা কিন্তু যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং মিষ্টি একটি নাম।

মনে হয় এই দেশের মানুষ বন্যার পানিতে বেঁচে থাকার পদ্ধতি বহু বছর থেকে জানে। ব্যাপারটা টের পাওয়া গেছে টেক্সাসের বন্যা দেখে। আমাদের দেশের পত্র পত্রিকায় সাদা চামড়ার মানুষের জন্য মায়া মনে হয় একটু বেশি, তাই দেশে বসে টেক্সাসের বন্যার খুঁটিনাটি আমরা জেনে গেছি! দেশটি যে এরকম দুর্যোগ সামলাতে পারে না সেটি খুব স্পষ্ট। যে বিষয়টি আমার আলাদাভাবে চোখে পড়েছে সেটি হচ্ছে সান্ধ্যকালনি কারফিউ। সেই দেশে বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর মানুষজন বাড়িঘর লূট করতে শুরু করল- এবং সেটা বন্ধ্য করার জন্য কারফিউ জারি করতে হলো! বন্যার সময় আমাদের দেশে হাজারো রকমের সমস্যা হয় কিন্তু বাড়িঘর রক্ষা করার জন্য কারফিউ দিতে হয় সেটি কখনো শুনিনি!

আমেরিকার জন্য এটি অবশ্য নতুন কিছু নয়-একবার নিউইয়র্ক শহরে কয়েকঘণ্টার জন্য ব্ল্যাক আউট হয়েছিল। তখন পুরো শহর লুটপাট হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে ব্ল্যাক আউট নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা, ভাগ্যিস আমরা এখনো আমেরিকান কায়দা কানুনে দিন কাটানো শিখিনি।

২.
আগস্ট মাসের মন খারাপ করা বড় ঘটনাটি সবাই জানে। রূপা নামের একটা কলেজ ছাত্রীকে বাসের ভেতর ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেল্পার সবাই মিলে গনধর্ষণ করে এক ধরনের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় হত্যা করেছে। প্রথম যেদিন খবরটি পত্রিকায় খবরটি বের হয়েছে আমি দেখেও না দেখার ভান করে চোখ সরিয়ে নিয়েছি। আমি দুর্বল প্রকিতির মানুষ, এই ধরনের খবরগুলো আমি সহ্য করতে পারি না। তাই সেগুলো থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চাই। কিন্তু মানুষ উঠ পাখি নয় যে বালুর ভেতর, সুখ গুঁজে রাখাতেই পৃথিবীর সব নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে- তাই ধীরে ধীরে আমাকেও রূপা নামের, এই অল্পবয়সী কলেজছাত্রীর ঘটনাটি আমাকে জানতে হয়েছে।

ঘটনাটি জেনেছি কিন্তু যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাঁরা কেমন করে এধরনের একটি ঘটনা ঘটাতে পারে সেই বিষয়টি কোনোভাবেই বুঝতে পারি না। বিচ্ছিন্নভাবে একজন বা দুইজন মানুষ যারা বিকৃত এক ধরনের মানসিকতা নিয়ে মানসিক রোগী হিসেবে বড় হয়েছে তাঁরা কোনোধরনের অপরাধবোধ ছাড়াই এরকম ভয়ংকর ঘটনা ঘটাতে পারে কিংবা ঘটিয়ে আনন্দ পায় সেটা আমরা জানি। কিন্তু একেবারেই পারিবারিক কয়েকজন মানুষ মিলে এই ধরনের নিষ্ঠুরতা করতে পারে সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। তবে কী আমাদের মেনে নিতে হবে এরকম ঘটনা সবসময়েই ঘটছে এবং যারা ঘটাচ্ছে তাঁরা বেশীরভাগ সময়েই পার পেয়ে যাচ্ছে তাই সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ এটাকে খুবই সহজ স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছে? আমরা শুধুমাত্র একটি দুটি ঘটনার কথা জানি তাই সমাজের আসল ছবিটি আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে যেগুলোর কথা পত্রপত্রিকায় আসে সেগুলোরও কি বিচার হয়? অপরাধী শাস্তি পায়? এই দেশের অনেক বড় আলোড়িত ঘটনা হচ্ছে তনু হত্যাকান্ড- ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এই হত্যাকান্ড ঘটেছিল বলে কী কখনো তনুর হত্যাকারীর বিচার হয়নি? হবে না?

আমাদের ডিকশনারিতে গনধর্ষণ শব্দটি ছিল না( কী কুৎসিত একটি শব্দ, লিখতে গিয়ে কলম সরতে চায় না)। আমরা শুধু পাকিস্তানে এই ঘটনা ঘটার খবর পেতাম এবং শুনে হতবাক হয়ে যেতাম। কীভাবে কীভাবে জানি এই ঘটনাটি বাংলাদেশেও ঘটতে শুরু করেছে, এখন এটি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিল্লীতে একটা বাসের ভেতরে একটি মেয়েকে এভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল, ঠিক তাঁর পরপরই আমাদের দেশের বাসে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে শুরু করল। নৃশংসতা কী অনুকরন করতে হয়? এটা কী একটা শেখার বিষয়? মনোবিজ্ঞানীরা কী এটা নিয়ে গবেষণা করে বিষয়গুলো আমাদের বোঝাতে পারবেন?

আজকাল খবরের কাগজগুলো খোলা যায় না। মনে হয় পুরো খবরের কাগজটাই বুঝি ধর্ষণের খবর দিয়ে বোঝাই। ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের নেতাদের ধর্ষণ, নানার নাত্নীকে ধর্ষণ,ঈদের দিনে আনন্দোৎসবে ধর্ষণ,বান্ধবীকে ধর্ষণ,স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধুকে ধর্ষণ, কমবয়সী শিশুকে ধর্ষণ শুধুমাত্র খবরের কাগজ পড়েই একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে।

আমি মনোবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের মানুষ নই তাই বিচ্ছিন্ন একটি মানুষ বা সমাজ কিভাবে অন্যায় করে কিংবা অন্যায়কে প্রতিহত করে সেটা জানিনা। কিন্তু কিছু বিষয় সবসময়ই আমাকে বিভ্রান্ত করে এসেছে। আমি একবার এক মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছি, নামাজ শেষে ইমাম দোয়া করতে করতে একসময় বললেন যারা এই দোয়ায় সামিল হয়েছে তাঁদের সবার গোনাই যেন সওয়াবে পরিনত করে দেওয়া হয়। আমি রীতিমত চমকে উঠলাম, কারণ সত্যিই যদি একদিন শুধুমাত্র দোয়া করে জীবনের সব পাপকে পুন্যে পাল্টে দেয়া যায় তাহলে সেটা কী মানুষকে অন্যায় করতে প্রলুব্ধ করবে না? সারাজীবন খুন জখম চুরি চামারী অত্যাচার অনাচার ধর্ষণ করে জীবনের শেষ প্রান্তে কোনো একটা প্রক্রিয়ায় যদি তাঁর সব পাপকে পুন্যে পরিনত করে ফেলা যায় সেটি নিশ্চয়ই অনেক পুন্য লাভের সবচেয়ে শর্টকার্ট পদ্ধতি। ধর্মের এই ব্যাখ্যা সমাজের কতো গভীরে কতো ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে আমি তা জানি না। সেটি এই দেশের মানুষের চিন্তাভাবনার জগতকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে সে সম্পর্কেও আমার কোনো ধারনা নেই। (আমি অবশ্যি পারিবারিকভাবে ধর্মের অনেক সুন্দর এবং মানবিক একটা ব্যাখা শুনে বড় হয়েছি। আমি জেনে এসেছি প্রত্যেকটা মানুষের উপর খোদার একটা হক আছে এবং মানুষেরও একটা হক আছে। খোদার হক পালন না করলে, খোদার কাছে কান্নাকাটি করে মাপ চাইলে খোদা চাইলে মাপ করে দিতেও পারেন। কিন্তু মানুষের হক পালন না করলে সেই মানুষটি যতক্ষণ পর্যন্ত মাপ না করবে ততক্ষন কোনো মুক্তি নেই । ধর্মের এই ব্যাখাতে সারাজীবন পাপ করে শেষ বয়সে সব পাপকে পুন্যে পাল্টে দেয়া কিংবা পাপকে মুছে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই!)

যারা রূপা মেয়েটির উপর এই নৃশংস অত্যাচার করেছে তাঁদের সবাইকে ধরা হয়েছে। মানুষগুলোর বাবা মায়েরাও তীব্র অপ রাধভোগে ভুগছেন, বলেছেন তাঁদের সত্যিকারের শাস্তি হওয়া উচিৎ। তাঁদের কী শাস্তি হবে আমরা জানি না। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যাবে কী না সেটাও আমরা জানি না। ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্যে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিতকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তারপরও যারা ধরা পড়েছে তাঁদের ফাঁসির আদেশ মওকুফ হয়ে গেছে। কয়েক বছরের ভেতরেই তাঁরা নিশ্চয়ই আরো বড় নেতা হিসেবে বের হয়ে আসবে! কাজেই রূপার হত্যাকারী এই মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ কী আমরা জানি না, জেল হাজতে বসে বসে তাঁরা কী ভাবে, তাঁদের বিবেক দংশন করে কি কী না কিংবা কোনো রকম অপরাধবোধে ভুগে কী না সে সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, কিছু অনুমানও করতে পারি না। কিন্তু মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে রূপার মনে কী ভাবনা কাজ করেছিল, সেটি আমরা কল্পনা করতে পারি। কমবয়সী এই মেয়েটির বুকের ভেতর নিশ্চয়ই ছিল গভীর হতাশা এবং এই বিশাল পৃথিবীর উপর তীব্র অভিমান। এই দেশ, এই রাষ্ট্রযন্ত্র, এই সমাজ কোনো কিছু তাকে রক্ষা করতে পারলো না। কী ভয়ঙ্কর একটি কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। আমি সেই কষ্টটুকুর কথা কল্পনাও করতে পারি না।

৩.
আগস্ট মাসের আরো একটি মন খারাপ করা ঘটনা হচ্ছে আমাদের পাশের দেশ মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার রোহিঙ্গা চরমপন্থীরা পুলিশ মিলিটারী ক্যাম্প আক্রমন করার পর তাঁর প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে সাধারন রোহিঙ্গা মানুষদের উপর। বাংলাদেশে পাঁচ লক্ষ থেকে বেশী রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে এক দশক থেকে বেশী সময় ধরে বসবাস করছে। গত কয়েকদিনে রোহিঙ্গাদের উপর রীতিমত গনহত্যা শুরু হওয়ার পর প্রান বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে ছুটে এসেছে। এটি অনেক বড় একটি ঘটনা সারা পৃথিবীতে এটা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। আমরা জানি এসব নিয়ে তোলপাড় হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে হইচই হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ তাঁর দায়িত্ব নেবে না, এই অসহায় মানুষগুলোকে অসহায়ভাবে এই দেশে মানবেতর জীবন কাটাতে। একাত্তরের পর বিহারীরা পাকিস্তানের নাগ্রিক হিসেবে কতো যুগ জেনেভা ক্যাম্পে কাটিয়ে দিয়েছে মনে আছে? এই রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর উপতাক্যয় ফিরিয়ে না নিয়ে মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হচ্ছে দেখে আমি একটু খানি শান্তি পাচ্ছি। আমি কিছুতেই ১৯৭১ এর ঘটনা ভুলতে পারি না, এই দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, যদি ভারতবর্ষ তখন আমাদের আশ্রয় না দিতো তাহলে আমাদের কী হতো? ১৯৭১ সালে আগরতলার মোট জনসংখ্যা থেকে বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল।

সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে মৃত্যুভয়ে কাতর অসহায় মানুষদের একটু খানি আশ্রয় দেওয়া অনেকখানি বড় কাজ। মানুষ হিসেবে অন্য মানুষদের জন্যে সেটা যদি না করি তাহলে কেমন করে হবে?

যে নোবেল কমিটি মায়ানমারের জননেত্রী অং সান সুচিকে শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার দিয়েছিলেন এখন তাঁরা মাথা চাপড়াচ্ছেন কিনা সেটা আমার খুব জানার ইচ্ছা করে।


বাংলা ইনসাইডার/জেডএ


 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭