ইনসাইড আর্টিকেল

বাংলার বিবাহিত আহার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 07/02/2021


Thumbnail

বাঙ্গালীর রসনা বিলাস খুবই ঐতিহ্যগত ও সুপ্রাচীন। হরেক নাম আর বাহারি পদের ভোজের আয়োজন এই বাংলা ছাড়া পৃথিবীর অন্যকোথাও মেলাভার। ভোজন রসিক বাঙ্গালীদের খাবারের তালিকায় যে সকল খাবারের নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে মাসকলাইয়ের ডালের বড়ি অত্যান্ত জনপ্রিয় একটি খাবার। ডালের বড়ি একক কোন রন্ধনশৈলীর উপকরন নয়। এটি মিশ্রপ্রকৃয়ায় রান্না করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের সবজির সাথে দিয়ে, বিশেষ করে মাছের বিভিন্ন পদের সাথে এই মাসকলাইয়ের বড়ি খাবারের স্বাদকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। কিন্তু এই বড়ির যদি ঘটা করে বিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে থাকে তাও আবার আমাদের মানুষের বিয়ের রীতি পুরোটাই মেনে, তাহলে নিশ্চয়ই বড়ি খাওয়ার থেকেও ঘটনাটা জানার প্রতি আগ্রহটাই আমাদের বেশি থাকবে।

ছাদনাতলায় উপস্থিত বর ও কনে। হাজির দুপক্ষের লোকজনও। শাঁখ বাজিয়ে রীতি মেনে পূর্ব পুরুষের প্রথা অনুসারে আজও এই বিয়ে হয়ে আসছে সনাতনী ঐতিহ্যবাহী বাঙ্গালী বাড়িতে। পাটায় বাটা হচ্ছে মাসকলাইয়ের ডাল, তৈরি বড় বড় দুটি বড়ি। সকাল থেকে উপোস করে, এরপর বাড়ি পরিষ্কার করে বাড়ির লক্ষ্মীরা, লক্ষ্মী পুজো করে বিয়ের শুভ সূচনা করে থাকে। পুজোর পর মাসকলাইয়ের ডাল ভিজিয়ে দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হল পঞ্জিকার সময় ধরে মাসকলাইয়ের ডাল বেটে বাড়ির মন্দিরের সামনে দুটো বড়িকে আলাদা করে বড় ও উঁচু বানাতে হয়। এই বড় ও উঁচু বানানোর পিছনে বাড়ির ঠাকুমাদের আছে মজার এক বিশ্বাস। তারা তাদের নাতনিদের বলে থাকেন, যার বড়ির নাক যত উঁচু হবে তার বরের ততই উঁচু হবে নাক। এই বড় বড়ি দুটোই হল বর ও কনে। সঙ্গের ছোট বড়িগুলো হল বর ও কনেপক্ষের লোকজন। বড় বড়ি দুটো বানানো শেষ হলে শুকনো লংকার গুড়ো সিঁদুরের মত পরিয়ে দেয়া হয়। কি সুন্দর লাগে তখন বড়ি দুটোকে! অন্যসব বড়ির থেকে একদমই আলাদা। পিঁড়ির ওপর দুটি বড় বড়ি রাখা হয় পাত্র পাত্রী হিসেবে। তারপর,রীতিমত প্রদীপ জ্বালিয়ে, উলুধ্বনি আর শাঁখ বাজিয়ে তুলসি দূর্বাঘাস দিয়ে বর বড়ি ও কনে বড়িকে আর্শীবাদ করেন বাড়ির গুরুজনেরা। পরিবারের মানুষদের বিশ্বাস কনে বড়ি হল তাদের বাড়ির মেয়ে।

বাড়ির মেয়ের বিয়ে তাই নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করা হয়। এই জন্য এই দিন বাড়ির সবাই নিরামিশ আহার করেন। সব মিলিয়ে অগ্রহায়ণ মাস পড়তেই বাংলার বিভিন্ন জেলা জুড়ে ‘বড়ির বিয়ে’ উৎসবে মেতে ওঠেন সবাই। আর এভাবেই হৈ-হৈ করেই চলে ‘বড়ির বিয়ে’ অনুষ্ঠান। অগ্রহায়ন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার বড়ির বিয়ে দিলে সংসারে মঙ্গল হয়। তাছাড়াও বড়ির বিয়ে দেওয়ার পর বাড়ির ছেলে মেয়েদের বিয়ে ঠিক করলে তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়। পূর্ব পুরুষদের সেই বিশ্বাস ও রীতি আজও পালন করা হচ্ছে এই বড়ি বিয়ে প্রথাটিতে। 

পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের কয়েকটি গ্রাম, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ,যশোর ও গাইবান্ধা জেলাসহ গোটা উত্তরাঞ্চল জুড়ে মাসকলাই ও কুমড়োর বড়ি তৈরিতে হাজার হাজার বউ, শাশুড়ি, মা, বোনেরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। শীত মৌসুমের শেষ সময়ে মাসকলাইয়ের ডালের আটা ও পাঁকা চাল কুমড়ো মিশিয়ে এ সুস্বাদু বড়ি তৈরি করা হয়। এ অঞ্চলের নারীরা শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কয়েক মাস পূর্বে থেকে চাহিদা মত চাল কুমড়ো পাঁকানোর ব্যবস্থা করে থাকেন। নতুন কলাই জমি থেকে ঘরে, বাজারে আসার সাথে সাথে বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। এ সব এলাকার আশি ভাগ মহিলারা পালা করে বড়ি দেয়ার কাজটি করে থাকেন।

লোকসংস্কৃতি গবেষক সঙ্কর্ষণ মাইতি বলেন, `মহিষাদল বলে নয়, মেদিনীপুর সহ ওপার বাংলা ও এপার বাংলায় অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মাসকলাই বা বিউলি ডালের বড়ি দেওয়া শুরু হয়। এসব অঞ্চলের গয়না বা নক্সা বড়ির মতো বড়ি অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।

রসনা তৃপ্তিতে এই বড়ির জুড়ি নেই। এখন সারা বছর তা বাজারে পাওয়া গেলেও বড়ি বানানোর মরসুম এই শীতের শেষ ভাগেই। বনেদিয়ানায় ছেদ পড়েছে হয়তো। হয়তো সময়ের জাঁতাকলে হারিয়ে গিয়েছে অনেককিছুই। তবুও দুই বাংলার কিছু কিছু জেলায় এখনও মেনে চলা হয় পূর্ব পুরুষের এই বড়ি’র বিয়ে রীতি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭