ইনসাইড থট

ইসলামের দৃষ্টিতে তামিমার তালাক কতটা সঠিক?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/02/2021


Thumbnail

বর্তমান সময়ে একটি বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার নাসির হোসেনের বিবাহ। তার স্ত্রী তামিমা সুলতানা তাম্মির সাবেক স্বামী রাকিব হাসানকে তালাকের বিষয়টি নিয়ে এই আলোচনা চলছে। এ বিষয় নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। সবশেষ বুধবার বিকেলে নাসির হোসেন এবং তার স্ত্রী তামিমা সুলতানা তাম্মি একটি সংবাদ সম্মেলন করে তালাকের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। আসলে তামিমা সুলতানা তাম্মি এবং তার সাবেক স্বামী রাকিব হাসানের তালাক ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা সঠিক হয়েছে সেটি নিয়েই আজ আলোচনা করবো।

তালাক কি:
তালাক শব্দের অর্থ হলো বিচ্ছিন্ন, ত্যাগ করা ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদকে তালাক বলা হয়ে থাকে। পরিভাষায় তালাক অর্থ "বিবাহের বাঁধন খুলে দেয়া, বা বিবাহের শক্ত বাঁধন খুলে দেয়া "স্বামী তার স্ত্রীর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া।

জীবনে চুড়ান্ত বিপর্যয় থেকে স্বামী স্ত্রী উভয়কে রক্ষার জন্য ইসলামে তালাকের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়,পরস্পর মিলে মিশে স্বামী স্ত্রী হিসেবে শান্তিপূর্ণ ও মাধুর্য মন্ডিত জীবন যাপন যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়,পারস্পারিক সম্পর্ক যখন তিক্ত,বিষাক্ত এবং একজনের মন যখন অপরজন থেকে এমন ভাবে বিমূখ হয়ে যায় যে, তাদের মিলনের আর কোন সম্ভাবনা থাকে না; ঠিক তখনই এই চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইসলামে। তালাক হচ্ছে নিরুপায়ের উপায়।

মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে- "কোন পুরুষ তাহার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাহিলে তাহাকে মুসলিম আইনে অনুমোদিত যে কোন পদ্ধতিতে ঘোষণার পরই তিনি তাহার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এ মর্মে চেয়ারম্যানকে লিখিত ভাবে নোটিশ প্রদান করবেন এবং স্ত্রীকেও উহার নকল দিবেন" অর্থাৎ তালাক প্রদান বা ঘোষণার ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের প্রবর্তিত পদ্ধতিই হচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইনের পদ্ধতি। বিশেষ করে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরী।

তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কেউ এর অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন গুনাহগার হবে, অন্যদিকে তালাকও কার্যকর হয়ে যাবে। তাই প্রত্যেক বিবেচক স্বামীর দায়িত্ব হলো তালাকের শব্দ কিংবা এর সমার্থক কোনো শব্দ মুখে উচ্চারণ করা থেকে সতর্কতার সঙ্গে বিরত থাকা। অতি প্রয়োজন ছাড়া স্বামীর জন্য যেমন তালাক দেওয়া জায়েজ নয়, তেমনি স্ত্রীর জন্যও তালাক চাওয়া নিষিদ্ধ। তালাকের পথ খোলা রাখা হয়েছে শুধু অতি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য।

ইসলামে তালাকের অবস্থান:
ইসলামী শরিয়তে অতি প্রয়োজনে তালাকের অবকাশ থাকলেও বিষয়টি অপছন্দনীয়। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল বস্তু হচ্ছে তালাক।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৭৭)

তাই নারী-পুরুষ উভয়ের কর্তব্য তালাক থেকে দূরে থাকা। তালাক দেওয়ার ক্ষমতা যেহেতু পুরুষের, তাই পুরুষকে ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সংযমী হতে হবে। অন্যদিকে নারীর ব্যাপারেও হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে নারী স্বামীর কাছে বিনা কারণে তালাক প্রার্থনা করে, তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৫৫)

স্ত্রীকে সংশোধনের কয়েকটি নির্দেশনা এবং তালাকের ধাপ:
যদি স্ত্রী স্বামীর আনুগত্য না করে, হক আদায় না করে, বরং উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে স্বামীর দায়িত্ব হলো তাকে সংশোধনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। শরিয়ত এ ধরনের স্ত্রীকে সুশৃঙ্খল জীবনে ফিরিয়ে আনতে কিছু দিকনির্দেশনাও দিয়ে দিয়েছে। প্রথমে সেগুলো অনুসরণ করবে। তার পরও যদি স্ত্রীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে চূড়ান্ত ফয়সালা তালাকের পথ বেছে নিতে পারবে।

প্রথম পদক্ষেপ : প্রথমেই উত্তেজিত হবে না; বরং নিজেকে সংযত রাখবে এবং মিষ্টি কথায় স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। মায়া-ভালোবাসা প্রকাশ করে মন গলানোর চেষ্টা করবে। কোনো ভুল ধারণায় থাকলে যথাসম্ভব তা দূর করার চেষ্টা করবে। মায়া-মমতার মাধ্যমে যত দূর সম্ভব দাম্পত্য জীবন স্থায়ী করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ : ওই পদক্ষেপের মাধ্যমে কাজ না হলে রাগ-অনুরাগ প্রকাশের উদ্দেশ্যে স্ত্রীর সঙ্গে রাত যাপন থেকে বিরত থাকবে। ঘুমানোর জায়গা পৃথক করে নেবে। যদি এতে সতর্ক হয়ে যায় এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয় তাহলে দাম্পত্য জীবন সুখের হবে।

তৃতীয় পদক্ষেপ : উল্লিখিত দুটি পদক্ষেপ গ্রহণের পরও কোনো কাজ না হলে তৃতীয় পদক্ষেপ হিসেবে শরিয়ত স্ত্রীকে হালকা শাসনের অনুমতি দিয়েছে। তবে ক্ষিপ্ত হয়ে নয়; বরং অন্তরে মহব্বত পোষণ করে বাহ্যিকভাবে স্ত্রীকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে তা করবে। তবে যেন এতে তার শরীরে কোনো দাগ না পড়ে এবং চেহারা বা স্পর্শকাতর কোনো স্থানে আঘাত না আসে।

চতুর্থত ও সর্বশেষ পদক্ষেপ : উল্লিখিত তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণের পরও কোনো কাজ না হলে চতুর্থ পদক্ষেপ হিসেবে নির্দেশ হলো—উভয় পক্ষ থেকে এক বা একাধিক সালিসের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করবে।

তালাক হলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত:
আর যদি পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে—মীমাংসা ও সংশোধনের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কোনোক্রমেই একমতে পৌঁছা সম্ভব না হয়—এ রকম চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে শরিয়ত স্বামীকে তালাক দেওয়ার এখতিয়ার দিয়েছে। তালাক অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ হলেও তা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা না থাকলে শরিয়ত সমর্থিত পদ্ধতিতে তালাক দেবে।

তালাক দেওয়ার শরিয়ত নির্দেশিত পদ্ধতি:
কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো—স্ত্রী যখন হায়েজ (মাসিক) থেকে পবিত্র হবে তখন স্বামী তার সঙ্গে সহবাস না করে সুস্পষ্ট শব্দে এক তালাক দেবে। যেমন—আমি তোমাকে এক তালাক দিলাম। এরপর স্বামী যদি স্ত্রীকে ইদ্দত চলাকালীন ফিরিয়ে নিতে চায় তাহলে তা পারবে। আবার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কায়েম হয়ে যাবে। অন্যথায় ইদ্দত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং স্ত্রী স্বামী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে। তখন স্ত্রী ইচ্ছা করলে অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে। তালাক দিতে একান্ত বাধ্য হলে এই পদ্ধতিতে তালাক দেওয়া কর্তব্য।

শরিয়ত নির্দেশিত পদ্ধতিতে তালাক দেওয়ার সুফল
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তালাকের পরে দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তির কথা মনে পড়ে পরস্পরের গুণ ও অবদান স্মরণ করে উভয়েই অনুতপ্ত হয় এবং বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করার  আপ্রাণ চেষ্টা করে। যদি শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী এক তালাক দেওয়া হয়, তাহলে এ আশা পূরণ হওয়ার সুযোগ থাকে এবং আবার বৈবাহিক জীবন শুরু করতে পারে। এ পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় স্ত্রীকে পুনঃ গ্রহণের অবকাশ পাওয়া যায় এবং তালাকের কারণে সৃষ্ট সমস্যা নিয়েও ভাবার সুযোগ থাকে।

আর যদি ইদ্দত শেষ হয়ে বিচ্ছেদের পর আবার তারা দাম্পত্য জীবনে ফিরে আসতে চায়, তাহলে নতুন মহর ধার্য করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অন্যত্র বিবাহের প্রয়োজন হবে না। দুর্ভাগ্যবশত, দ্বিতীয়বারও তাদের মধ্যে বনিবনা না হলে এবং আবার তালাকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশনার পূর্ণ অনুসরণ করে ওই সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

উল্লেখ্য, তালাকের সময় স্ত্রী গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত তার ইদ্দতের সময়। আর গর্ভবতী না হলে তিন হায়েজ (মাসিক) অতিক্রম হওয়া পর্যন্ত।

তবে স্বামী যেহেতু স্ত্রীকে দুই ধাপে দুই তালাক প্রদান করেছে, তাই এখন শুধু একটি তালাক তার অধিকারে আছে। এই তৃতীয় তালাক প্রদান করলে আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না এবং আবার বিবাহও করতে পারবে না। কেননা এই সুযোগ দুই তালাক পর্যন্তই সীমিত। যে ব্যক্তি উপরোক্ত পদ্ধতিতে দুই তালাক দেওয়ার পর আবার বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করবে, তাকে আগামী দিনগুলোতে খুব হিসাব-নিকাশ করে চলতে হবে। একটু অসতর্কতার কারণে তৃতীয় তালাক দিয়ে ফেললে আর এই স্ত্রীকে নিয়ে ঘর-সংসার করার সুযোগ থাকবে না; বরং সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যাবে।

শরিয়তের নির্দেশনা অমান্য করার কুফল:
এভাবেই ইসলামী শরিয়ত বৈবাহিক সম্পর্ক অটুট রাখার অবকাশ দিয়েছে। কিন্তু মানুষ শরিয়তের এই সুন্দর পদ্ধতি উপেক্ষা করে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির লোকদের মধ্যেই এ প্রবণতা দেখা যায় যে, তারা যখন রাগে ক্ষোভে লিখিত বা মৌখিকভাবে তালাক দেয় তখন একসঙ্গে তিন তালাকই দিয়ে থাকে। তিন তালাক দিলে ইদ্দত চলাকালেও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না এবং ইদ্দতের পরেও নতুনভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে না। একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় অনুতপ্ত হওয়া এবং আপসের জন্য আগ্রহী হওয়া কোনো কাজে আসে না।

যারা তিন তালাক দেওয়ার পর শরিয়তের বিধান জানতে মুফতি সাহেবদের কাছে আসে, তাদের অনেককেই দেখা যায় অত্যন্ত অসহায়ত্বের সঙ্গে নিজের দুঃখের কথা বলে মুফতি সাহেবের মন গলাতে চেষ্টা করে। নিষ্পাপ সন্তানদের কথা বলে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করতে থাকে—যেভাবেই হোক কোনো হিল্লা-বাহানা বের করে তার পরিবারটিকে যেন ধ্বংস থেকে বাঁচানো হয়। কিন্তু এসব আবদার-অনুরোধ বিফল। তার নিজ হাতেই সব সুযোগ বিনষ্ট হয়েছে। তালাক দেওয়ার শরিয়তসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারণে স্ত্রী তার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে গেছে। উপরন্তু শরিয়তের নিয়ম অমান্য করে মারাত্মক গুনাহ করা হয়েছে। আর অন্যায়ভাবে তালাক দেওয়ায় স্ত্রীর ওপর চরম জুলুমও করা হয়েছে, যা আরেকটি কবিরা গুনাহ। এখন আবার তাকে স্ত্রীরূপে ফিরে পাওয়ার যে সম্ভাবনাটি রয়েছে তা অত্যন্ত দূরবর্তী সম্ভাবনা।

প্রচলিত হিল্লা বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ:

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তিন তালাকের পরই স্বামী-স্ত্রী উভয়েই নানা রকম হিল্লা-বাহানার আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। এটা যেমন অশালীন, তেমনি শরিয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ ও লানতযোগ্য কাজ।

উপরন্তু হিল্লা-বাহানা গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের দুশমনদের ইসলামের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তারা হিল্লা বিয়ে নিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে থাকে। অথচ ইসলাম এ ধরনের হিল্লা বিয়ের অনুমতিই দেয় না। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭