ইনসাইড থট

ভেনামি চিংড়ির অপরাধ কি?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 27/02/2021


Thumbnail

উৎপাদন,স্বাদ, বাজার মূল্য, ঐতিহ্য ও আভিজাত্য এসব কিছুর কারণে আমরা গলদা ও বাগদা চিংড়ির সাথে খুবই পরিচিত । ভেনামি চিংড়ির সাথে মোটেই পরিচিত নই । যেমন গলদা বা বাগদার বৈজ্ঞানিক নাম সাধারণ মানুষ জানেনা । ভেনামিও এক প্রজাতির চিংড়ি মাছের বৈজ্ঞানিক নাম (বৈজ্ঞানিক নাম : Litopenaeus vennamei ) । এটি প্রশান্ত মহাসাগর সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশে অতি পরিচিত । আবাসস্থল ছিল প্রধানত: মেক্সিকো । সেখান থেকে পেরু, ইকুয়েডর, আর্জেটিনা হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া । এশিয়ায় বরং এখন এর কদর, উৎপাদন সবকিছু বেশী । পৃথিবীর প্রায় ৬২টি দেশে ভেনামি চিংড়ির চাষ হয় , এর মধ্যে এশিয়ার দেশ ১৬টি । কারণ এ চিংড়ির বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য । এর মধ্যে আছে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশী অর্থাৎ ক্রান্তীয় অঞ্চল বা কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে লবণাক্ত পানিতে চাষাবাদ, সাথে আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কম আয়তনে বেশী পরিমাণ চিংড়ি চাষের সুবিধা এবং খাবার অনুপাতে চিংড়ি বৃদ্ধির পরিমাণ বেশী ইত্যাদি । এসব কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ তথা ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড , ভিয়েতনামে ভোনামী চিংড়ির চাষ, উৎপাদন এবং রপ্তাণি বৃদ্ধি ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। বিশ্ব বাজারে হিমায়িত চিংড়ির বর্তমান রপ্তাণি চিত্র সে তথ্যই প্রদান করে :

 

                                 দেশের নাম  রপ্তাণিকৃত অর্থের শতকরা হার
                                 ১.  ভারত   ২৪.৯%
                                 ২. ইকুয়েডর  ২১.১%
                                 ৩. ভিয়েতনাম  ১১.১%
                                 ৪. ইন্দোনেশিয়া  ০৭.৩%
                                 ৫. আর্জেন্টিনা  ০৬.০%
                                 ৬. থাইল্যান্ড  ০৩.৮%
                                 ৭. চীন  ০২.৯%
                                 ৮.  মেক্সিকো  ০২.২%
                                 ৯.  বাংলাদেশ ০২.১%

 

হিমায়িত চিংড়ি রপ্তাণিতে ভারত পৃথিবীতে সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে, যা বাংলাদেশের তুলনায় ১২ গুণের বেশী । কিন্তু তাদের চিংড়ি চাষের জমি কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম । স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে আছে বলে আমরা গর্ব করি । কিন্তু আমাদের মাছ উৎপাদনের এলাকা বিশাল । বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্লাবন ভূমির এলাকা এবং এশিয়ার মাছ চাষের এলাকা বিবেচনায় আমাদের অবস্থান তৃতীয়। এদেশে চিংড়ি চাষের এলাকা প্রায় ২.৭৬ লক্ষ হেক্টর, এর মধ্যে বাগদা চিংড়ি চাষ এলাকা ১.৯৫ লক্ষ হেক্টর এবং গলদা চিংড়ি চাষ এলাকা ৮১ হাজার হেক্টর । সে তুলনায় ভারতের উপকুল অনেক বেশী লম্বা হলেও চিংড়ি চাষের এলাকা ১.৬৫ লক্ষ হেক্টর । অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশ্যা, পশ্চিম বাংলা এবং তামিলনাডুসহ কয়েক রাজ্যের কিছু অংশে চিংড়ি চাষ হয় । এর মধ্যে ৯০% হচ্ছে ভেনামি চিংড়ির চাষ । ২০১৯ সালে তাদের উৎপাদন ছিল ৮.০৫ লক্ষ টন । বাগদা চিংড়ি যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি উৎপাদন সর্বোচ্চ ৪০০ কেজি, সেখানে হেক্টর প্রতি ভেনামির উৎপাদন প্রায় ৪০০০ কেজি। ফলে দ্রুত বেড়েছে সেখানে ভেনামি চিংড়ির চাষ ।
ভেনামি চিংড়ির এ অঞ্চলে প্রথম চাষ শুরু করে থাইল্যান্ড । ১৯৯০ এর দশকে বাগদা চিংড়ির চাষ কার্যক্রমে যখন ভাইরাস  (White Spot Syndrome Virus-WSSV) আক্রমণ শুরু হয়, তখন থেকেই এ চিংড়ি চাষীদের বিপর্যয় শুরু হয় । পরে দেখা দেয় Slow Growth Syndrome Virus এর আক্রমণ।


এ ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশসহ সকল দেশের বাগদা চিংড়ি চাষীরা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে । যার সমাধান এখনও হয়নি । ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে বিকল্প পদক্ষেপ হিসেবে থাইল্যান্ডে ২০০১ এ অত্র অঞ্চলের জন্য সুবিধাজনক ভেনামি চিংড়ি চাষের কার্যক্রম শুরু করে । পরের বছর ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় একই পথ ধরে ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু হয় । তবে ভারত ২০০৮ সালে সরকারী অনুমোদন দিয়ে ব্যাপকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের কার্যক্রম শুরু করে । ফলও পায় হাতে হাতে । ২০০১ সালে ভারতের চিংড়ি উৎপাদন ছিল এক লক্ষ টন । আর ২০১৯ সালে তাদের উৎপাদন হয়েছে ৮.০৫ লক্ষ মেট্টিক টন । এর মধ্যে ৯০% ভেনামি চিংড়ি । তাদের উৎপাদন আরও বৃদ্ধির পরিকল্পনা ও কার্যক্রম আছে । ইন্দোনেশিয়ার আছে মহাপরিকল্পনা । তারা ১৬০ লক্ষ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ উৎপাদক হবার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে । অপরদিকে শুধুমাত্র ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন না করায় বিগত বছর গুলোতে আমাদের হিমায়িত চিংড়ির রপ্তাণি কমেছে।


বিগত কয়েক বছরেআমাদের চিংড়ি রপ্তাণির ক্রমহ্রাসমাণ রপ্তাণি চিত্র আরও নিম্নগতিতে নামার আশঙ্কা প্রকাশ করে :

অর্থবছর  হিমায়িত চিংড়ী রপ্তাণি
২০১০-২০১১  ৫৪,০০০ মেট্টিক টন
২০১৬-২০১৭  ৩৯,৭০৫ মেট্টিক টন
২০১৭-২০১৮  ৩৬,১৬৮ মেট্টিক টন
২০১৮-২০১৯  ৩৩,৩৬২ মেট্টিক টন

 

বাংলাদেশের উৎপাদিত চিংড়ির ৩৯% আমেরিকায় রপ্তাণি হতো । সে বাজার ভেনামি চিংড়ির কারণে ভারত ও অন্য দেশের হাতে চলে গিয়েছে । ভারত বিশ্বে এখন সব চেয়ে বেশী চিংড়ি উৎপাদন করে এবং তাদের রপ্তানীর প্রায় ৫০% আমেরিকায় এবং ২৫% চীনে রপ্তাণি হয় ।


ভেনামি চিংড়ির উৎপাদনের সুযোগ সব দেশের নেই । ম্যানগ্রোভ সম্বলিত উপকুল, লবণাক্ত পানি, উষ্ণ তাপমাত্রা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য ও সুযোগ সব আমাদের আছে । সুযোগ হচ্ছে চায়ের চায়ের কাপে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ার মত । একটু বিলম্ব করলে বিস্কুট হারিয়ে যায় । আমাদের অনুকুল পরিবেশ ও প্রতিবেশ থাকায় সুযোগ এখনও হারায়নি, তবে রপ্তাণি বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে । ভারতের ১.৬৫ হেক্টরের চিংড়ি এলাকার মধ্যে আমাদের পার্শে¦ পশ্চিম বাংলার ৫১,০০০ হেক্টর । একই আবহাওয়া, পানি, পরিবেশ, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছু । সেখানে ১০ বা ১২ বছর যাবৎ ভেনামি চিংড়ির চাষ হলে আমাদেরও চাষ করতে অসুবিধা কোথায়? চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তাণি প্রতি বছর কমলেও এটি এখনও আমাদের রপ্তাণি আয়ের দ্বিতীয় খাত । প্রথম খাত পোশাক শিল্প অনেক এগিয়ে । কাজেই ভেনামি চিংড়ির চাষ হলে আমাদের রপ্তাণি বৃদ্ধি  বৃদ্ধি পাবে । এ সঙ্গে  চিংড়ি চাষ ও প্রক্রিয়াকরণের সাথে সম্পর্কিত লক্ষ লক্ষ মানুষের দুরাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে । এ খাতে ঘটতে পারতো অনেক কিছু ।কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কারণে হয়নি । এটা ভেনামি চিংড়ির দোষ নয় । দোষ আমাদের । ২০১৮ সালে পূর্বানী হোটেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, চিংড়ি শিল্প মালিক, চিংড়ি চাষী সকলকে নিয়ে ভেনামি চাষ বিষয়ে সেমিনার হয়েছে ।  টেকনিক্যাল কমিটি এবং উপ-কমিটি গঠিত হয়েছে । আমাদের অফিসারদের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কমিটি গঠন করার একটা মানসিকতা আছে । প্রয়োজনে একাধিক কমিটি গঠন এবং নথিতে “আলোচনা করুন” লিখে নথি ফিরিয়ে দেয়া এ অভ্যাসটা আমাদের  উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া । যুগ বদলে গেছে, প্রযুক্তি এগিয়েছে, কিন্তু অভ্যাস বদল হয়নি । ভেনামি চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই এর জন্য গঠিত হয়েছে টেকনিক্যাল কমিটি । কাজ করছে পরীক্ষমূলক ভেনামি চিংড়ি চাষ সংক্রান্ত উপ-কমিটি । ০২টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে খুলনার পাইকগাছার লোনা পানি কেন্দ্রের ০৬টি পুকুরে ঐ কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের ব্যবস্থাপনায় ভেনামি চাষের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে । উক্ত ০২টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান করোণার কারণে থাইল্যান্ড থেকে পোনা আনতে পারেনি । তইি বিগত বছর সেখানে কোন পরীক্ষামূলক চাষ হয়নি । এ বছর তারা পূনরায় পোনা আনার চেষ্টা করছে । ভারত বা থাইল্যান্ড , ইন্দোনেশিয়ায় ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরুর সময় আমাদের কার্যক্রম গ্রহণ বাঞ্চনীয় ছিল । যেহেতু বিলম্ব হয়েছে, কাজেই ০২টি ছোট বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতার উপর নির্ভর না করে সরকারী উদ্যোগে ও খরচে এবং প্রয়োজনে বিশেষ কার্গো বিমানে এ চিংড়ি পোনা এনে পরীক্ষমূলক চাষের কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন । যেহেতু আমরা খুব বেশী বিলম্ব করেছি, কাজেই প্রক্রিয়াটি এখন ত্বরান্বিত করা খুবই জরুরী।

 

লেখক: সাবেক সচিব।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭