ইনসাইড আর্টিকেল

রহস্যের চাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 03/03/2021


Thumbnail

আপনি কি চাকাবিহীন একটি পৃথিবীর কথা চিন্তা করতে পারেন? ভাবুনতো চাকাবিহীন একটি পৃথিবী, যেন সবকিছুই থেমে গেছে। থেমে গেছে কলকারখানার চাকা, থেমে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। থেমে গেছে কুমোরের চাকা। পৃথিবীর, সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণন না থামলেও, থেমে যাবে পৃথিবীতে মানুষের যোগাযোগ আর কাজকর্ম। সাম্প্রতিক কালের প্রপেলার, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপ এবং টারবাইন-এর সবই কিন্তু চাকারই পরিবর্তিত রূপ। তাহলে এই কথা খুব সহজেই অনুধাবন  করা যায় যে, চাকার ঘূর্ণয়নের উপরে ভর করেই আজকের মানব সভ্যতা এতদূর এগিয়ে এসেছে। উন্নয়নের ধারায় চাকা হচ্ছে সবথেকে প্রাচীন ও প্রশংসনীয় আবিষ্কার। ইতিহাসবিদদের মতে চাকা আবিষ্কার না হলে হয়তো আজকের পৃথিবী উন্নয়নের এই অব্যাহত ধারা থেকে পিছিয়ে থাকতো হাজার বছর পিছনে। চাকা আমাদের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। চাকা ছাড়া আমদের জীবন হয়ে উঠত আসম্ভব জটিল আর শ্রমোময়। যেখানে আমরা সামান্য একটু পথ হাটতে চাইনা, সেখানে এই চাকা আমাদের নিয়ে যায় দূর থেকে দুরান্তে। কিন্তু কারা কিভাবে করেছিল এই চাকার আবিষ্কার?

ঐতিহাসিকদের ধারনা  চাকা আবিষ্কারের শুরুটা হয় যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩৬০০ বছর পূর্বে রোমানিয়ার কুকুটেনি ট্রিপিলিয়ান সভ্যতায়। শুরুতে কুমোরদের কাজে এই চাকার ব্যবহার ছিল। ককেশাসের উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেয়া হয়েছে। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরানো নিদর্শন।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দ নাগাদ চাকার ব্যবহার ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের দিকে। এদিকে চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায় ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, যখন চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন হয়। তবে বারবিয়েরিলো এর মতে আরও পূর্বে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দিকে চীনে চাকার প্রচলন ছিলো। 

অবাক করা ব্যাপার হল মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন সভ্যতায় কিন্তু এই চাকার ব্যবহার দেখা যায় না। তবে অলমেক ও অন্যান্য কিছু আমেরিকার সভ্যতার নিদর্শনের মধ্যে শিশুদের খেলনা হিসেবে চাকাযুক্ত গাড়ির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। মজার ব্যপার হল প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এসব খেলনাতে চাকার ব্যবহার থাকলেও আমেরিকার সভ্যতাগুলোতে যানবাহনের যন্ত্রাংশ হিসেবে কোন চাকার প্রচলন ছিল না।

এদিকে প্রাচীন নুবিয়াতে চাকা ব্যবহার করা হতো মাটির হাড়ি,পাত্র তৈরীতে এবং পানি উত্তোলনের কাজে। নুবিয়ার পানি উত্তোলনে ব্যবহৃত চাকাগুলো ঘুরানো হতো গবাদিপশু দিয়ে। আবার নুবিয়ার অধিবাসীরা মিশর থেকে আনা অশ্বচালিত রথ ব্যবহার করতো। ইতিহাস মতে যুদ্ধে ব্যবহৃত রথে এ ধরণের চাকা তারা ব্যবহার করতো।

সে সময় চাকা ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত সমতল বা মসৃণ রাস্তা না থাকায় চাকার প্রচলন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। যেসব এলাকায় রাস্তা ছিলনা এবং অসমতল ভূমির উপর দিয়ে চলাচল করতে হয়েছে, সেসব এলাকায় চাকা-যুক্ত যানবাহনের বদলে মানুষের কিংবা পশুর পিঠে করে মাল বহন করা হতো। এমনকি বিংশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বের অনেক অনুন্নত এলাকা গুলোতে ভালো রাস্তাঘাটের অভাবে চাকাযুক্ত যানবাহনের ব্যবহার কম ছিল।

নির্মাণ কৌশলে শুরুতে চাকা নির্মাণ করা হতো কাঠের চাকতি দিয়ে, যার কেন্দ্রে অক্ষদণ্ডের জন্য একটি গর্ত করা হতো। তবে স্পোকযুক্ত চাকা অনেক পরে উদ্ভাবিত হয়। এই রকমের চাকার ব্যবহারের ফলে গাড়ির ওজন কমিয়ে আনে, যার ফলে দ্রুতগতির বাহন তৈরি করা সম্ভব হয়। প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সমকালীন আন্দ্রোনভ সংস্কৃতিতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার পাওয়া যায়। এর অল্প পরেই ককেশাস এলাকার অধিবাসীরা অশ্বচালিত বাহনে স্পোকযুক্ত চাকা ব্যবহার শুরু করে।

পরবর্তীতে এখান থেকে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার ছড়িয়ে পরে গ্রিক উপদ্বীপে। চাকাযুক্ত বাহনের ব্যবহার গ্রিক সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ নাগাদ কেল্টিকদের রথগুলোতে এমন চাকা ব্যবহার করা হতো,  যার পরিধি বরাবর লোহার বেষ্টনি দেয়া থাকতো। ফলে এ ধরণের চাকাগুলো অনেক মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হতো। স্পোকযুক্ত চাকা এভাবেই প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থাতে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ব্যবহৃত হয়ে আসে। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চাকায় নিউম্যাটিক টায়ার ব্যবহার করা শুরু হয়। যার ফলে চাকার ইতিহাসে যুক্ত হয় এক নতুন অধ্যায়ের। আমরা এতক্ষণ গাড়ি ঘোড়ায়, কলকারখানায় বা অন্য অনেক জায়গায় চাকার ব্যবহারের কথা শুনলাম। এই চাকার বাইরেও কিন্তু রয়েছে আর একধরনের চাকা আর তা হল “ভাগ্যের চাকা”।

‘’ভাগ্যের চাকা’’ কথাটা শুনলে প্রথমে মনে আসে প্রাচীন পুরাণে উল্লেখিত ভাগ্য দেবতার কথা। আবার অনেকেই হয়তো বলবেন ক্যাসিনো বা জুয়ার আসরের চাকার কথা। এখানে উভয় ক্ষেত্রেই চাকার ব্যবহার রয়েছে। প্রাচীন গ্রীক অথবা রোমানদের ধারণা ছিল যে, ভাগ্য দেবী যার উপর সহায় হন ভাগ্যের চাকা তার দিকে ঘুরিয়ে দেন। রোমান পণ্ডিত সিজারিও এবং গ্রীক সাহিত্যিক পিন্ডার দুজনই এই ভাগ্যদেবীর কথা বলেছেন। এমনকি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তার কতগুলো নাটকে এই ভাগ্যের চাকা শব্দটি কয়েকবার ব্যবহার করেছেন যেমন- হে ভাগ্য, শুভ রাত্রি, আরেকবার মিষ্টি হেসে তোমার চাকাটা ঘোরাও! তবে চাকা যেটাই হোক সঠিক সময়ে না ঘুরলে গন্তব্য হতে পারে বহুদুর। 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭