ইনসাইড থট

অর্থনীতি মজবুত করতে প্রয়োজন কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 06/03/2021


Thumbnail

বাংলাদেশের অর্থনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত কৃষি। ২০১৮ অর্থবছরে জিডিপির প্রায় ১৪.২৩% অংশ অর্জিত হয় কৃষি খাত থেকে। জনমানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদানের প্রধানতম এবং অন্যতম উৎস কৃষি। দেশের বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানও হয়ে থাকে কৃষিকে অবলম্বন করেই। কৃষিবান্ধব নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, জীবনযাত্রায় মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে কৃষিক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগ দিয়েছেন। ফলে গত এক যুগ ধরে কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা বর্তমান সরকারের কৃষি ভাবনার এক বাস্তব প্রতিফলন।

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষক। কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষ এই খাতের প্রসারে প্রচুর শ্রম ব্যয় করছেন। কৃষিকে গুরুত্বহীন করে শুধু শিল্পখাতের উন্নয়নে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ দেখাবে না। কৃষির যথাযথ বিকাশ সাধনের পাশাপাশি শিল্পের ও সেবাখাতের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হলে তা মজবুত অর্থনীতির ভিত গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের অবস্থা তেমন সমৃদ্ধ নয়। কৃষিভিত্তিক পাটশিল্প, বস্ত্রশিল্প, চামড়াশিল্প, চিনিশিল্প, চা শিল্প-এই কয়েকটা বাদ দিলে বাকিগুলোর তথ্য-উপাত্ত তেমন নেই। আজ শুরু তো কাল শেষ। শুরুটা যেমন সুপরিকল্পিত নয়, তেমনি কিভাবে শেষ হয় তারও কোন হদিস খুঁজে পাওয়া যায় না।

কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠায় তেমন পরিকল্পনা বা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কৃষি উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইইএফ ফান্ডের নামে যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তাতে কৃষিভিত্তিক শিল্পের কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, খোঁজ নেওয়া দরকার। অথচ কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে কৃষিশিল্প যে কোন শিল্পের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেত।
আমদানী নির্ভর কাঁচামাল দিয়ে গড়া শিল্প কারখানা সাধারণত লাভজনক হয় না। কারন এতে মূল্য সংযোজন হয় না। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষি কাঁচামাল সহজলভ্য। কৃষিপণ্যকে যদি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে গন্য করে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাবনা যাচাই করে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হয় তাহলে বাংলাদেশ আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে, বর্তমান থেকে আরও অনেক উন্নতিতে।

চীন, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ অনেক দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের নানাবিধ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে সারা বিশ্বে বাজারজাত করছে। তদ্রূপ কৃষিপণ্য ব্যবহার করে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও মজবুত হবে। 

বরিশাল ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিপুল পরিমাণ সুস্বাদু পেয়ারা উৎপাদিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ও টাঙ্গাইলের মধুপুরের মিষ্টি ও সুস্বাদু আনারস দেশের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের উর্বর মাটিতে বিপুল পরিমাণ তরমুজ, বাংড়িসহ বিভিন্ন প্রকার রসালো মৌসুমী ফল উৎপাদিত হয়। মৌসুমের সময় কৃষকরা নামেমাত্র মূল্যে এই সকল ফল বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। অথচ কৃষিশিল্প প্রতিষ্ঠা করে এই সকল পেয়ারা, আনারসসহ অন্যান্য মৌসুমী ফল ব্যবহার করে জেলি, জুস, স্কোয়াস ও অন্যান্য নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা যায়।

বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল সারাদেশে উৎপাদিত হলেও জয়দেবপুরের লাল মাটিতে কাঁঠালের উৎপাদন খুবই বেশি হয়। কাঁঠালের মৌসুমে প্রকৃত উৎপাদনকারীরা একেবারেই মূল্য পায় না। যা কিছু উপার্জন করে তা মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং খুচরা বিক্রেতারা। অথচ থাইল্যান্ডে কাঁঠালের কোষ এর ‘চিপস’ তৈরি করে সুন্দর মোড়কে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বাজারজাত করছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত স্থানীয় জাতের কলা অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু। স্থানীয় বাজারের চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত কলার পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে ঐ কলা বিক্রি করার জন্য সাধারণত চট্টগ্রাম শহরের বাজারে সরবরাহ করা হয়। এই সুস্বাদু কলার ‘চিপস‘ তৈরি করে দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা যায়। আমেরিকা, কানাডা, জাপানসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে কলা, কাঁঠালের চিপসসহ বিভিন্ন প্রকার ফলের তৈরী রকমারী খাবারের বাজার রয়েছে। সারাবিশ্বে বাংলাদেশের উৎপাদিত আম, আনারস, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারাসহ বিভিন্ন প্রকার ফল ও কৃষিপন্য দিয়ে তৈরী উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে। শুধু তাই নয় সম্প্রতি জাপানে বাংলাদেশে উৎপাদিত মিষ্টিআলুর চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশে কয়েক ধরনের মিষ্টি আলুর চাষ হয়। সাম্প্রতিক চাহিদার কারণে  জাপানীদের পছন্দনীয় জাতের মিষ্টি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। জাপানে মিষ্টি আলু রপ্তানী করার জন্য কৃষি মন্ত্রনালয় বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মিষ্টিআলু বিদেশে রপ্তানীযোগ্য হওয়ায় মিষ্টি আলুর মূল্যও বেড়েছে। মিষ্টি আলু দিয়ে জাপানীদের পছন্দনীয় রকমারী খাবার তৈরি করেও রপ্তানী করার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। ফলে মিষ্টি আলুর তৈরী খাবারে মূল্য সংযোজিত হবে। কৃষক অধিক মূল্য পাবে, মিষ্টি আলুভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। এমনিভাবে অন্যান্য ফল উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশেষায়িত কৃষিপণ্য রপ্তানী অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে চাহিদা মোতাবেক চাষাবাদ, ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে রপ্তানীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। 

সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত দুধের ৮১ ভাগ মিষ্টির দোকানে ও চায়ের দোকানে ব্যবহার করা হয়। তৃণমূল খামারীরা মিষ্টির দোকানদার ও চা দোকানদার এর মর্জির উপর নির্ভরশীল হয়। যদি আবহাওয়া খারাপ থাকে তবে দুধ বিক্রি হয় না। প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদিত দুধ ক্রয়কারী ছোট ছোট ব্যবসায়ীদেরও  উৎসাহিত করার জন্য নগদ অর্থ প্রদান করছেন। কিন্তু এরপর কি?

এই ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ক্রয় করা দুধ সমন্বয় করে বৃহৎ দুগ্ধশিল্প স্থাপন করে চাহিদা অনুযায়ী অধিক পরিমাণ দুধ পাস্তরিত করে প্যাকেটজাত করা যেতে পারে এবং অধিক সংখ্যক গুড়াদুধ উৎপাদনের শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরন করা যায়। এই গুড়াদুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরীর মুল উপাদান ‘দুধের ছানা’ তৈরী করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক খামারীদের উৎপাদিত দুধ উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি নিশ্চিত হবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ বা সামাজিক অস্থিরতার কারণে বা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বা যে কোন কারনে দুগ্ধ খামারীদের ব্যবসা, বিনিয়োগ, বিপনন মিষ্টির দোকানদারদের মর্জির উপর নির্ভরশীল হবে না। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দুধের ‘মূল্য সংযোজন’ (Value Add) হবে, দুধের অতিরিক্ত মূল্য পেয়ে খামারীরা গাভী পালনে আরও উৎসাহিত হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। নিজের দেশে উৎপাদিত মানসম্মত গুড়াদুধ দিয়ে চাহিদা মিটাতে পারলে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। 

মুসলমানদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ‘ঈদ উল আযহা’বা কোরবানীর ঈদ। এ সময় তারা সমর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানী করে। সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী গত বছর প্রয়োজনীয় সংখ্যক (১ কোটি ৮০ লক্ষ) পশু বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়েছে। বিদেশ থেকে পশু আমদানী করতে হয় নাই। ফলে বিগত দিনে কোরবানির পশু আমদানি করতে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো, তা সাশ্রয় হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে Beef Fattening পদ্ধতির  মাধ্যমে মাংস উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করছে এবং বিদেশে রপ্তানি করার পরিকল্পনা করছে।

সাধারতঃ কোন পণ্য যখন রাসায়নিক ক্রিয়া বা যে কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুনরূপে আবির্ভূত হয় বা নতুন পণ্য হিসেবে তৈরী হয় যাতে নতুন বা বেশী মূল্য সংযোজিত হয় বা value add হয় সেটাই শিল্পজাত দ্রব্য। কৃষি পণ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রক্রিয়াজাত করে মূল্য সংযোজন করে বাজারজাত করাই কৃষি ভিত্তিক শিল্প। কৃষিশিল্প বলতে শস্যবীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে জৈব সার উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করে রকমারি খাবার প্রস্তুতকরণ, বাজারজাতকরণ, রপ্তানীকরণ, মৎস্য হ্যাচারি, মৎস্য খাবার, মৎস্য খামার, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, গোখাদ্য-পোল্ট্রী খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, পোল্ট্রি হ্যাচারী, Beef Fattening, ডিম-দুধ-মাছ-মাংস উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরন, বাজারজাতকরণ, ইত্যাদি। 

কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষিশিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি ভিত্তিক শিল্পে সহজলভ্যে প্রাপ্ত কৃষি পণ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করলে উৎপাদিত পণ্যে মূল্য সংযোজন হয়, ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পেয়ে অধিক পরিমাণ কৃষি পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত হয়। এতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত পন্য স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করার পর অতিরিক্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানী করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। ফলে দেশের অর্থনীতি মজবুত ও টেকসই হবে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭