নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 07/04/2021
অতীত আত্মোপলব্ধির এক চমৎকার স্থান হলো হাসপাতালের বেড। জেলখানার অন্তহীন প্রহরের সাথেও এর দারুণ মিল রয়েছে। বন্ধু-সুহৃদ-শুভাকাঙ্ক্ষীকে চিহ্নিত করার জন্যও এ সময়টা বোধকরি অতুলনীয়। নিজেকে চেনা, ভুল-ত্রুটির হিসেব করা, ভালো-মন্দ কাজের মূল্যায়ণ করার এত নিখুঁত ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবনার অবকাশ হয়তো অন্যসময় সেভাবে কেউ পায় না।
২) এদেশে খুব বেশি মানুষ পাওয়া যাবে না যিনি কখনো কখনো নিজের জীবনের চেয়েও সরকারি দায়িত্বকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। অপরিনামদর্শীর মত ঝুঁকি নিয়েছেন নিজের ভূত-ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে। অথচ বিগত বছরগুলোতে আমি এমন কিছু করেছি যা আমাকে আজ মরণঘাতী করোনা ভাইরাস নিয়ে উপুড় হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে গভীরভাবে ভাবাচ্ছে এবং আমার সর্বসত্তা ও মননকে নাড়িয়ে যাচ্ছে।
৩) ২০১০ সাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হিসেবে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শিল্প- সাহিত্য-সংস্কৃতির লালন এবং চর্চা, নির্বাচন, প্রগতি- বিনাশী শক্তির বিরুদ্ধে অনবরত লড়াই করতে গিয়ে বহুবার জীবন সংসারের কথা ভুলে যাই। সফলতাও ছিল বলে দাবি করতে পারি। ২০১২ সাল থেকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ধসে পড়ায় জীবনহানি ঠেকাতে উন্মাদ- উন্মত্ত লক্ষ জনতার ভেতরে গিয়ে শারীরিক আঘাত প্রাপ্ত হয়েও এক পা সরে আসি নি। তখনকার হেফাজতের ভয়ঙ্কর থাবা, গাছকাটা-অবরোধ, মৌলানা সাইদিকে চাঁদে দেখা যাওয়া, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে কত বহুমুখি চ্যালেঞ্জ ও আক্রমণের শিকার হয়েছি তবুও দেশ ও সরকারের প্রশ্নে পিছপা হইনি ।
৪) বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনাসহ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাপর ঘটনাবলীতে নজিরবিহীন দেশপ্রেমের ব্রত নিয়েছি। পরিবারের দিকে তাকাই নি। সর্বদা চোখের আলোয় কেবল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, সরকার, মানুষ আর প্রকৃতি এর বাইরে আমি কিছু দেখি না।
৫) তবে আজ থেকে দশমাস আগে স্বাস্থ্যসেবা সচিব হিসেবে পদায়ণ ও যোগদান সময়টি আমাকে সারাক্ষণ পীড়িত করে, বেদনাবিধুর করে। আদেশ হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে আমার স্ত্রীকে বললাম, করোনা বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছি। চলো গ্রামে যাই। আমি আর,টি/পিসিআর
ল্যাব স্থাপনের কাজে ব্যস্ত থাকবো। তুমি বাচ্চাদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ক`দিন থেকে আসতে পারো। তার মন সায় দিচ্ছে না বলে জানালেও অনেকটা জোর করে নিয়ে যাই। সেখানেই সে করোনা আক্রান্ত হলো। কয়েক দিন থেকে গেল এবং বিষয়টি গোপন রাখলো। স্বাস্থ্য সচিবের স্ত্রী`র কোভিড হয়েছে শুনলে মানুষ কি ভাববে ইত্যাদি। যথারীতি বিলম্ব করে ঢাকায় আসা। আমার যোগদান হবে হবে। বললো,তোমার সচিব হওয়াটা দেখে যাই। এর জন্য দু`দিন অপেক্ষা। যোগদান শেষে আমার দিনভর কাজ। সন্ধ্যায় ফিরে আসলাম। তাকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বাচ্চারা যাচ্ছে সাথে । আমি কতৃপক্ষের নির্দেশে সি,এম,এস, ডি,তে কিট সমস্যাবিষয়ক জরুরি সভায় গেলাম। কে জানতো তার আর ফিরে আসা হবেনা। এদিকে সাথে না যাওয়ার অব্যক্ত কষ্ট তিলে তিলে আমাকে খেয়েই যাচ্ছে, নিঃশেষ করে দিচ্ছে ক্রমাগত। হয়তো শেষদিন অবধি তা থামবার নয়। আমার ব্যর্থতা, আমার অনুশোচনা তিনদশকের অধিক কালেও চাকরিকে কখনো একবিন্দু অবহেলা করতে পারি নি। শুধু ভাবছি, স্ত্রী`র `করোনা` দিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় আমার চাকরি শুরু করে নিজের `করোনা` দিয়ে শেষ করলাম।
৬) একটি কথা না বললেই নয়, সুদীর্ঘ সময়ের সুখ দুঃখ ভয়ের চাকরিতে দশদিনের বেশি অর্জিত ছুটি কাটাই নি। শুনে আমার সহকর্মীগণ প্রায়শই বিস্মিত হন। বলে, এত ছুটি কার জন্য জমা করলে? আমার জবাব নেই। পাথর চোখ আমার। এর উত্তর আমার প্রয়াত স্ত্রীকেও কোনদিন দিতে পারি নি।
তবু আমার সৌভাগ্য। মাঠ প্রশাসনের এমন ঐতিহ্যধারক স্তরসমূহে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুবর্ণসুযোগ করে দেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাঁর প্রতি নিত্য- শ্রদ্ধাবনত হয়ে আরও কিছু দাবি করতে পারি এমন ধৃষ্টতা যেন আমার কখনো না হয়। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ আমৃত্যু সমানভাবে বহাল থাকবে। এমনকি পরম্পরায় আমার সন্তানরাও তা ধরে রাখবে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট এন্ড হসপিটাল, ঢাকা।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭