ইনসাইড আর্টিকেল

মনোহরিণী দিঘী রাম সাগর

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 08/04/2021


Thumbnail

সাগর না হলেও বিশালতা দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দিঘী রাম সাগর। সৌন্দর্যের বিশালতা এটি সাগরের মতোই। উত্তরের কক্সবাজারখ্যাত দিনাজপুরে এর অবস্থান। যার স্বচ্ছ নীল জল যুগ যুগ ধরে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে চলেছে। দিঘীর চারপাশ ঘিরে সবুজের বেষ্টনী, লাল মাটির উঁচু-নিচু টিলা আর অপরূপ নৈসর্গ প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপ্রিয়দের নিমিষেই মুগ্ধ করে।

দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে এই রাম সাগর। দিঘির পাড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, সেগুন, আমলকী, হরীতকী, দেবদারু, জারুল, কাঞ্চন, নাগেশ্বর, কাঁঠালিচাঁপা, বটসহ ১৫২ রকমের গাছ রয়েছে। রয়েছে হরেক রকমের ফুল গাছ। ১৯৬০ সালে এই দিঘিকে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে আনা হয়। ১৯৯৫ সালে রামসাগরকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র এবং ২০০১ সালে রামসাগরকে ঘিরে গড়ে ওঠা বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দেশের সবচেয়ে ছোট জাতীয় উদ্যান ‘রাম সাগর জাতীয় উদ্যান’। দূর থেকে দেখে রাম সাগরকে তাই অরণ্য বলেও ভ্রম হতে পারে।

দিনাজপুরের রাজ বংশের অনন্য ইতিহাস ধারণ করে টিকে রয়েছে এই রাম সাগর। ঐতিহাসিক রাম সাগরের সৌন্দর্য অবলোকনে প্রতিনিয়তই এখানে আসেন দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক। এছাড়া রাম সাগরের নীল জলরাশি ঘেঁষে পশ্চিম অংশের উঁচু টিলায় গড়ে তোলা হয়েছে মনোরম ডাক বাংলো। রাম সাগর জাতীয় উদ্যানে রয়েছে একটি চিড়িয়াখানা। এটি দিঘীর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ডাক বাংলো ঘেঁষা। চিড়িয়াখানার সংগ্রহও কম নয়। এখানে রয়েছে অজগরসহ কয়েক প্রজাতির সাপ, বানর, পাখি, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী। চিড়িয়াখানার পাশেই ছিমছাম শিশু পার্ক। পার্কটিতে শিশুদের খেলার বিভিন্ন সরঞ্জামের পাশাপাশি রয়েছে কৃত্রিমভাবে তৈরি বিভিন্ন প্রাণী।

রাম সাগরের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের পাথরের ঘাট। বড় বড় আকারের বেলে পাথর দিয়ে ঘাটটি নির্মিত। রাম সাগর দিঘীর আয়তন ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯২ বর্গমিটার। দিঘীটির প্রস্থ ৩৬৪ মিটার ও গভীরতা গড়ে প্রায় ৯ মিটার। এর পাড়ের সর্বোচ্চ পাড়ের উচ্চতা প্রায় ১৩ দশমিক ৫০ মিটার।

ঐতিহাসিকদের মতে, দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথের রাজত্বকালে অর্থাৎ ১৭২২-১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের আগে ১৭৫০-১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই রামসাগর দিঘি খনন করেছিলেন। তারই নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় রাম সাগর। দিঘিটি খনন করতে তৎকালীন প্রায় ৩০ হাজার টাকা এবং ১৫ লাখ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়েছিল। 

এই দিঘি নিয়ে প্রচলিত আছে বিভিন্ন লোককথা। কথিত আছে, ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রচণ্ড এক খরা দেখা দিলে পানির অভাবে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে হাজার হাজার প্রজা। এসময় দয়ালু রাজা প্রাণনাথ স্বপ্নাদেশ পেয়ে একটি পুকুর খনন করেন। মাত্র ১৫ দিনে এর খনন কাজ সম্পন্ন হয়। কিন্তু সেই পুকুর থেকে পানি না ওঠায় একসময় রাজা স্বপ্নে দৈববাণী পেলেন যে, তার একমাত্র ছেলে রামকে দীঘিতে বলি দিলে পানি উঠবে। 

স্বপ্নাদিষ্ট রাজা, দীঘির মাঝখানে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করেন। তারপর এক ভোরে যুবরাজ রামনাথ সাদা পোষাকাচ্ছাদিত হয়ে হাতির পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু করলেন সেই দীঘির দিকে। দীঘির পাড়ে পৌঁছে যুবরাজ রাম সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে দীঘির তলা থেকে অঝোর ধারায় পানি উঠতে লাগল। চোখের পলকে যুবরাজ রামনাথসহ পানিতে ভরে গেল বিশাল দীঘি।

আরও একটি লোককাহিনী শোনা যায়। দিঘি খনন করার পর রাজা রামনাথ পানি না উঠলে স্বপ্ন দেখেন রাজা দিঘিতে কেউ প্রাণ বিসর্জন দিলে পানি উঠবে। তখন রাম নামের স্থানীয় এক যুবক দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দেয়। পরবর্তিতে রাজার নির্দেশে সেই যুবকের নামে দিঘির নামকরণ করা হয় রাম সাগর।

রামসাগর এখন গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র। শীতকালে অনেক পরিযায়ী পাখি আসে এখানে। প্রতিবছর মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে এখানে বসে বারুণি মেলা। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া রাজপুত্র রামনাথের স্মরণে প্রতিবছর এই দিনে স্নান করতে এখানে আসেন।

কিভাবে যাবেন:
রাম সাগর দিঘী দেখতে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যাতায়াত করা সম্ভব। ব্যক্তিগত যান ছাড়াও দেশের যেকোনো জেলা থেকে বাস বা ট্রেনে করে যাওয়া যায় দিনাজপুরে। ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেনে সরাসরি দিনাজপুর শহরে যেতে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০০-৭০০ টাকা। চাইলে ঢাকা থেকে বিমানে যাওয়া যায় সৈয়দপুরে। সেখান থেকে বাসে বা অন্যান্য যানে দিনাজপুর। এরপর দিনাজপুর শহর থেকে দক্ষিণ দিকে রাম সাগর মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরত্বের পথ।

থাকার ব্যবস্থা:
রাম সাগর দর্শনে গিয়ে সেখানে থাকার জন্য রাম সাগরের অভ্যন্তরের ডাক বাংলো রয়েছে। এজন্য বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করতে হবে। শহরের হাউজিং মোড়ে রয়েছে পর্যটন মোটেল। মোটেলের ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকেও এখ‍ানকার কক্ষ বুকিং দেওয়া যায়। এছাড়া শহরের স্টেশন রোড, গণেশতলা, চারুবাবুর মোড়, মালদহপট্টি, নিমতলা এলাকায় বিভিন্ন প্রকৃতির আবাসিক হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ১০০-৫০০ টাকার মধ্যে রাত যাপনের সুযোগ রয়েছে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭