ইনসাইড আর্টিকেল

খাবারে বাঙালিয়ানা, বৈশাখে ষোল আনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/04/2021


Thumbnail

আদিকাল থেকেই বাঙালির ভোজন প্রিয়তা ছিল বৈচিত্রময়, সৃজনশীল এবং বাঙালিয়ানার স্বতন্ত্র বৈশিষ্টপূর্ণ। বাঙ্গালির খাবার বাংলার ঐতিহ্যেরই একটা অংশ। খাবারের তীব্র ঘ্রাণ নাকে গেলে জিভে পানি না এসে আর উপায় নেই। সময়ের সাথে সাথে বাঙালির খাবারে পরিবর্তন চলে এলেও নববর্ষে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে খাবারে রাখা হয় শতভাগ বাঙ্গালিয়ানা। বাংলা নতুন বছরকে বরণ করা এখন একটি সার্বজনীন উৎসবের সামিল। যে যার মতো বাঙালিয়ানাকে উদযাপনের যথাযাসধ্য চেষ্টা করে। সেই বাঙালিয়ানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এখন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে `পান্তা-ইলিশ` খাওয়ার রীতি। কিন্তু এর চর্চা প্রাচীন-মধ্য কোনো যুগেই দেখা যায়নি। মাছেভাতে বাঙালি প্রচলিত, কিন্তু বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ খেতে হবে, এটা কোথাও কখনোই প্রচলিত ছিল না। কেননা বৈশাখ একটি খরার মাস। এসময় কোনো ফসল হতো না আর কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকতো না। সুতরাং তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সেই সময়ে ইলিশ সস্তা হলেও বছরে ২-১ বারই ইলিশ খাওয়ার সুযোগ হতো সাধারণ বাঙালির। সুতরাং এটা মোটেও সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতো। গ্রামবাংলায় নববর্ষের উৎসবই ছিল খুবই সাধারণ আর ছোট আকারে। কৃষাণী আগের রাতে একটি নতুন ঘটে কাঁচা আমের ডাল ও চাল ভিজিয়ে রাখতেন। সকালে কৃষক সেই চালপানি খেয়ে হালচাষ করতে যেত। দুপুরবেলায় কাজের ফাঁকে পান্তা খেতো কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে আবার কখনো কখনো একটু শুঁটকি, বেগুন ভর্তা বা  আলু ভর্তা দিয়ে। কবির ভাষায় তাইতো তখন বলা হয়েছে-

"পান্তা ভাতে মরিচ-পেঁয়াজ
গরম ভাতে ভর্তা
সকাল বিকাল খেয়ে জবর  
ঘুমায় গাঁয়ের কর্তা।"
 
বৈশাখে পান্তা-ইলিশ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাঙালি খাবার নিয়ে কারো কোন অভিযোগ নেই। বাঙালি বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন বাংলার খাবার সে ঠিকই খুঁজে বের করবে। কারণ যে খেয়েছে বাংলার খাবার সে কখনো ভোলেনি, ভোলা যায় না। বাংলার খাবারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে এই খাবারের বৈচিত্র্য। কত ধরণের খাবার যে বাংলার মেন্যুতে আছে তা কল্পনাও করা যায় না। এদের স্বাদ একটার চেয়ে আরেকটা বেশি। বাংলার চিরায়ত সাদা ভাতের সাথে খাওয়া যায় অন্তত ১০০ রকমের মিষ্টি পানির মাছ, আরও আছে সমুদ্রের মাছ, শতরকমের ভর্তা, ভাজি, সবজির নানা পদ, আলু ভাজি, বেগুন ভাজি, শুক্তো, বড়ি, কলার মোচা, অনেক রকমের শুটকি, নানা পদের ডাল, আচার, গরু, খাসি, মুরগি, হাঁসের মাংস রান্না এবং আরো কত কি।

বাঙালির রসনাতৃপ্তিতে ভর্তা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অনেক বাঙালি পরিবারে ভর্তা অত্যাবশকীয়। হাতের সাহায্যে কিংবা শিলপাটায় বেটে ভর্তা তৈরি হয়। তবে ভর্তার গুণগানের সঙ্গে মরিচ, রসুন, খাঁটি সরিষার তেল জড়িত। আলু, পটোল, বরবটি, শিম, মিষ্টি আলু, ডাল, টমেটো, বেগুন, ডিম, শুঁটকি মাছ, পুদিনাপাতা, ধনেপাতা, লাউয়ের খোসা, চিংড়ি, কচু, ঢেঁড়স, মরিচ, কালিজিরা, সরিষা, কাঁচকলা, ডাঁটাশাক, মটরশুঁটি, লাউপাতা, আম, পেয়ারা, বড়ি, রসুন, মিষ্টি কুমড়া, পালংপাতা, ফুলকপি, পেঁয়াজপাতা, কাঁঠালের বিচি, মটরশাক, ওল, মানকচু, টাকি মাছ, কুলবরই, কাঁচা আমের ভর্তা তৈরিতে বাঙালি গৃহবধূরা সিদ্ধহস্ত। বৈশাখের থালায় তাই ভর্তার আদিক্ষেতা বেশ চোখে পড়ে।

বাঙালির ঘরে একটা হলেও আচারের বয়াম থাকে। আচারের সঙ্গে টকের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। খিচুড়ি আচার, ডাল আচার, শাক আচার, মুড়ি মসলায় আচার খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। অনেকে শুধুই আচার খান। আচারের স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। টক, ঝাল, মিষ্টি—এই তিন রকম স্বাদের আচারই বেশি দেখা যায়। আম, জলপাই, চালতা, তেঁতুল, আমড়া, পাতিলেবু, কুল দিয়েই সাধারণত আচার তৈরি হয়। পাশাপাশি মরিচ, টমেটো, আমলকী, রসুন, আদাসহ নানা ধরনের সবজি দিয়ে অনেকে আচার তৈরি করেন। মরিচ, মেথি, জোয়ান, মৌরি, ধনে আচারের মূল মসলা। এ ছাড়া খাঁটি সরিষার তেল ও কড়া রোদ আচারের জন্য খুবই জরুরি। বাঙালির বাঙালিয়ানায় তাই আচার এর ভূমিকাও রয়েছে।

বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত নকশি পিঠা। নানি, দাদি, মা-বোনরা তাঁদের মন থেকে পাখি, ময়ূর, মাছ, ফুল, লতা-পাতা, পুতুল, বর-বউ নকশি পিঠায় ফুটিয়ে তোলেন। চালের গুঁড়া, ময়দা, মুগ ডাল, চিনি, নারিকেল ও তেল দিয়ে নকশিপিঠা তৈরি হয়। মিষ্টি স্বাদের নকশিপিঠা তৈরির চল দেশের প্রায় সব জেলায় রয়েছে। তবে কেউ কেউ ঝাল ও নোনতা স্বাদের নকশিপিঠাও তৈরি করেন। আতপ চালের গুঁড়া সিদ্ধ করে কাঁই দিয়ে তৈরি হয় মোটা রুটি। তারপর খোঁপার কাঁটা, খেজুরকাঁটা, সুঁই, পাটকাঠি, ঝাঁটার কাঠি দিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন আকার-আকৃতির  নকশিপিঠা। তেলে ভেজে চিনির সিরায় ডুবিয়ে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। নকশিপিঠাকে জামাই-ভোলানো পিঠা, বিবিয়ানা পিঠাও বলা হয়। এ ছাড়া নকশা অনুযায়ী নকশি পিঠার বিভিন্ন নাম রয়েছে; যেমন—শঙ্খলতা, কাজললতা, চিরণ, হিজলপাতা, কন্যামুখ, জামাইমুখ, চম্পাবরণ ইত্যাদি।

কথায় আছে বাঙ্গালির বার মাসে তের পর্বণ বা উৎসব। তবে বৈশাখের উৎসব হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। উৎসব-পার্বণে ভোজনপ্রিয় বাঙালির খাদ্যতালিকায় রসগোল্লা, নকশিপিঠা, কদমা-বাতাসা, খই, মুড়ি-মুড়কি, পায়েস অনিবার্য। পালা-পার্বণ, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় উৎসবে এসব সুস্বাদু খাবার শত বছর ধরে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। বৈশাখেরর আয়োজনে এমন লোভনীয় খাবারের তালিকা থাকাও আবশ্যক এখন। কারণ এগুলো বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য বহন করে আসছে যুগ যুগ ধরে।  দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭