ইনসাইড আর্টিকেল

কবিতা ও গানে বৈশাখ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/04/2021


Thumbnail

বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক পহেলা বৈশাখ। বাঙালি জীবনের সর্বত্রই এর অবাধ বিচরণ। বাঙালির পোশাকের রঙে, অথবা গ্রাম্য মেলার নতুন বাঁশির সুর থেকে শহুরে পান্তা ইলিশ খাওয়ার ধুমে, উপলক্ষ শুধু পহেলা বৈশাখ। নববর্ষ উদযাপনের চিত্র শুধু এগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। এ যেন বাঙালির শিল্প সাহিত্যের এর দোলা। বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো কবি নেই, যিনি বৈশাখ নিয়ে কবিতা লেখেননি কিংবা যাদের কবিতায় বৈশাখ আসেনি। একটি সাধারণ গবেষণায় জানা যায়, বাংলায় বৈশাখ নিয়ে ছোট-বড় ২৮৭৪টি কবিতা রচিত হয়েছে। পরোক্ষভাবে পয়লা বৈশাখ এসেছে- এমন কবিতার সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলা কবিতায় নববর্ষ যেভাবে, যত বহুমাত্রিকতায় এসেছে- তা অন্য কোনো জাতির নববর্ষে আসেনি। এর মধ্য দিয়েই বুঝতে পারা যায়, সব সময়ই বৈশাখ এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বের ছিলো। নতুন বছরকে বরণ করার জন্য নিজ থেকেই তারা প্রস্তুতি নিতো। বাংলাদেশে এখনাকার বৈশাখী উৎসব মানেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চির পরিচিত গান-

`এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো...`

এই গানের মধ্য দিয়েই নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া অধিকাংশ অনুষ্ঠানমালার শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের বটগাছরূপে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু সেজন্যই নয়। বরং তার জীবন ঘনিষ্ট এই রচনা বাঙালিদের মনে নাড়া দেয়। আলোড়িত করে, নতুনভাবে শুরু করার উৎসাহ দেয়। এছাড়া `বৈশাখ আবাহন` বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ নিয়ে লেখা সর্বাধিক গাওয়া কবিতা/গান। বৈশাখ নিয়ে সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত ছড়ার রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ; ছড়াটি হচ্ছে :
`আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।`

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে শুরু করলেও বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে গেলে আমরা নতুন বছরের শুরু নিয়ে তখনকার কবিদের উচ্চারণ খুঁজে পাই। মধ্য যুগের সৃষ্টি মঙ্গল কাব্যের মধ্যে বৈশাখ বিষয়ক পঙক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। মধ্য যুগের অন্যতম কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০)  চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতু ও ফুল্লরার দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখের চমৎকারভাবে কষ্টের বর্ণনায় প্রচণ্ড দাবদাহের মাস বৈশাখের কথা স্মরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন-
`বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।
তরুতল নাহি মোর করিকে পসরা
পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন
নিযুক্ত করিল বিধি সবার কাপড়।
অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের দুড়`

মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.) বৈশাখকে দেখেছেন প্রকৃতির মতো বহুমুখী ক্রিয়া আর বৈচিত্র্যিক রূপময়তার উৎস হিসেবে। বৈশাখী প্রকৃতির সঙ্গে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মানব মনের মিল এবং সে মিলে দেখেছেন মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের উপর হার্দিক প্রভাব আর চিরন্তন ঋতুচক্রের পারিবর্তনিক বোধের অনুপমতায় সুখ-দুঃখ আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিহ্বলতা-
`ভূতরূপে সিন্ধুজনে গড়ায়ে পড়িল
বৎসর কালের ঢেউ, ঢেউর গমনে
নিত্যগামী রথ চক্র নীরবে ঘুরিল
আবার আয়ুর পথে হৃদয় কাননে
কত শত আশা লতা শুকায়ে মরিল
হায়রে কব তা কারে, কবিতা কেমনে
কি সাহসে আবার তা রোপিব যতনে
সে বীজ, যে বীজ ভূতে বিভল হইল।`

বৈশাখ নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিবেদনকে সম্মান জানাতে হয়; বৈশাখের স্বকীয় স্বরকে তিনি নিজ সাধনে নতুন সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। বৈশাখ মাস শুধু যে কাল-বৈশাখী নিয়েই প্রকৃতির প্রতি নিদারুণ উত্তপ্ত প্রকাশে থাকছে তা নয়। বৈশাখের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো ‘বৈশাখী ঝড়’, সেই ঝড়ের আওয়াজ বাতাসের শনশন শব্দে গেঁথে তোলায় তার মতো কে আর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। একটি কাব্য গীতির দ্বিতীয় অন্তরায় বর্ণনায় কবি নজরুল তার প্রেয়সীকে মনে করেন। অস্থির মনের বাণীতে বৈশাখী ঝড়ের বর্ণনা পাই-
`বৈশাখী ঝড়ে রাতে চমকিয়া উঠি জেগে`
বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে,
ঝড় চলে যায় কেঁদে ঢালিয়া শ্রাবণ ধারা
সেকি তুমি? সে কি তুমি?`

আধুনিক বাংলা কবিতার রাজপুত্র যাকে বলা যায় সেই কবি জীবনানন্দ দাশও তার কবিতায় বৈশাখি কামনাভরা জীবনের ছবি এঁকেছেন। তার কবিতায় বৈশাখের জোছনার রাত ছায়াময় আর রৌদ্রের দিন রঙিন। গ্রীষ্মের রঙিন রোদ্দুর  বিলাসে মেতে ওঠেন। উষ্ণতাভরা বৈশাখের চিত্রে লিখেছেন-
`বৈশাখের মাঠের ফাটলে
এখানে পৃথিবী অসমান।  
আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।  
কেবল খড়ের স্তূপ পড়ে আছে দুই-তিন মাইল
তবু তা সোনার মতো নয়;
কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে
করুণ, নিরীহ, নিরাশ্রয়।`

কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় বৈশাখ আবির্ভূত হয়েছে অভাব, যন্ত্রণা ও কষ্টের প্রতীক হিসেবে। অভাব-অনটনে অতিষ্ঠ হয়েও অনেকসময় মানুষ দুর্দান্ত সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। তা হলে দেখা যাচ্ছে, শেষতক এদের কবিতায়ও বৈশাখ সংগ্রামী চশমায় সজ্জিত।  
`রাত্রি ফুরালে জ্বলে ওঠে দিন
বাঘের থাবায় মরছে হরিণ
কাল বোশেখের তান্ডবে কাঁপে পড়ো পড়ো চাল
শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল ইচ্ছে তার ইচ্ছে।`

বাংলাদেশের নাগরিক জীবনে যে সাংস্কৃতিক চেতনায় পহেলা বৈশাখের উৎসব হচ্ছে, তা প্রবর্তনের কৃতিত্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনিই প্রথম শান্তিনিকেতনে ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। এর অংশ হিসেবে বৈশাখ বরণের উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি বাংলা নতুন বছরকে সম্ভাষণ জানিয়ে রচনা করেছেন বহু কালজয়ী সংগীত ও কবিতা। ত্রিশ পরবর্তী বাংলা কবিতার উজ্জ্বল সময়  পঞ্চাশ ও ষাটের প্রধান কবিরা তাঁদের আত্মপ্রকাশকারী কবিতাগ্রন্থের শিরোনামে স্থান দিয়েছেন বৈশাখের মুকুটকে। ; সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য `বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা` এবং মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই `বৈশাখী পূর্ণিমা`। বৈশাখ প্রেমের মাস না হলেও বৈশাখ পুরাতন স্মৃতি-জরা-গ্লানি পেছনে ফেলে নতুনকে-সবুজকে আবাহনের কাল, বৈশাখ নতুনের সাথে হাত ধরে চলার প্রেরণা।  



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭