ইনসাইড থট

ইতিহাস কথা বলে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 21/04/2021


Thumbnail

সাম্প্রতিক সময়ে আমার অনুজপ্রতিম মহিউদ্দিন আহমেদ `প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান` এই নামে একটি বই লিখেছেন। আমি সেই বই সম্পর্কে অথবা তার লেখা সম্পর্কে কোনো আলাপ-আলোচনা করার উদ্দেশ্যে লিখতে বসিনি। বইটির ১৩৩নং পৃষ্ঠায় আমার নাম উল্লেখ করেছেন তার একটি ইন্টারভিউয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আমি তার বইয়ের কিছু লেখার অংশ লিখছি পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য। বইয়ের ১৩২নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সুলতান উদ্দিনের ছোট ভাই কামাল। তখন সে স্কুলের ছাত্র ছিল। সে তখন বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করে এবং এই মামলায় কী করা যায়, সেই পরামর্শ চায়। কেননা, কামালের বড় ভাই সুলতান উদ্দিন আহমেদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৪নং আসামি। কামালের ভগ্নিপতি কামাল উদ্দিন, তিনি এই মামলার ২নং সাক্ষী। এ অবস্থার মধ্যে বেগম মুজিবের অবস্থা তখন ভালো নয়। দলের লোকেরা তার বাড়ির ছায়া মাড়ায় না। শেখ মুজিবের পক্ষে মামলা চালানোর জন্য উকিল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি (বেগম মুজিব) কামালকে বললেন, `তুমি সিরাজুল আলম খানের কাছে যাও।` সে (কামাল) সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে দেখা করে। সিরাজুল আলম খান কামালকে নানা পরামর্শ দিলেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফাইনাল বর্ষের ছাত্র সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী সাক্ষী কামালের পরিবারের খোঁজ-খবর রাখতেন।

এখন আমি ভূমিকাটুকু লিখলাম শুধু পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য। সেই অবস্থার মধ্যে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব খুব কম সংখ্যক লোকের সঙ্গে আমার জানামতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনে আদেশ-নির্দেশ দিতেন। আমি আগরতলা মামলার শুরু থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে হেঁটে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে মাঝে মাঝে সপ্তাহে একবার, মাঝে মাঝে দুই সপ্তাহে একবার বঙ্গমাতার সঙ্গে গিয়ে দেখা করতাম। সত্যিকার অর্থে বঙ্গমাতার সঙ্গে দেখা করা, চা-বিস্কুট খাওয়া, গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা খুবই কম হতো। কেননা, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি হলেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার সঙ্গে বঙ্গমাতার আলাপ করার বিষয়বস্তু খুব কম ছিল। আমি আমার কিছু লেখায় এর আগে উল্লেখ করেছি, আমি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় মাঝে মাঝে ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গমাতার সঙ্গে দেখা করতাম। একবার দেখা করার সময় আমি বঙ্গমাতার কাছে একটি লিফলেট ছাপানোর জন্য কিছু অর্থ সাহায্য চাই। আমার যতদূর মনে আছে, এই বিষয়ে আমাকে বঙ্গমাতার কাছ থেকে অর্থ সাহায্য চাওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান। আমার মনে আছে, তখনকার সময়ে বঙ্গমাতা ১০০ টাকা দিয়েছিলেন। আমার লিফলেট ছাপাতে খরচ হয়েছিল ৬৫ টাকা (অনেক পরে জানতে পেরেছি যে, তিনি আমাদের যে অর্থ সাহায্য করতেন, সেটি ছিল তার গহনা বিক্রি করা অর্থ)। যখনই বঙ্গমাতার সঙ্গে দেখা হতো, তিনি আমাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ এই কঠিন সময়ে ভালোভাবে চলছে- এটা বঙ্গমাতার জানা ছিল। এ বিষয়ে খুব একটা আলাপ-আলোচনা আমার সঙ্গে হয়নি। বরং এখন যদি চিন্তা করি তাহলে আমার মনে হয়, মাঝে মাঝে বঙ্গমাতার সঙ্গে দেখা করতে যাই, এতেই তিনি আমার প্রতি খুব স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাতেন, সেইভাবে আদর করতেন।

একদিন তিনি আমাকে বসতে বললেন এবং আমি টুলের ওপরে বসলাম। বঙ্গমাতা বিছানার ওপরে বসে খুব গুরুত্ব সহকারে জানালেন, রাজসাক্ষী কামাল উদ্দিন বৈরী হয়েছেন অর্থাৎ তিনি এখন সরকারের পক্ষে সাক্ষী দেবেন না। এ কারণে সরকারের লোকজন কামাল উদ্দিনকে এমনভাবে অত্যাচার করেছে, সে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী। সরকার এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কামাল উদ্দিনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কেবিনে ভর্তি করেছে এবং আর একটি কেবিনে কামাল উদ্দিনের স্ত্রীর ভাই সুলতান উদ্দিনকেও একইভাবে অত্যাচার করে ভর্তি করেছে। এই সংবাদটা দেওয়ার পর বঙ্গমাতা আমাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বুঝিয়ে বললেন, আমি কোনো অবস্থাতেই ওপরে উল্লিখিত দু`জনের খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা না করি এবং এ কথাও বললেন যে, তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মূলত আমাকে জানালেন। যাতে করে আমি নিজেকে সতর্ক করতে পারি এবং বুঝতে পারি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারের লোকজন ঘোরাফেরা করছে। তারপর আমাকে দায়িত্ব হিসেবে (কামাল উদ্দিনের রাজসাক্ষী যিনি তৈরি হয়েছেন) তার পরিবারের যেন খোঁজ-খবর নেই এবং তিনি বললেন, তার পরিবার মগবাজারের কোনো একটা জায়গায় থাকে বলে বঙ্গমাতার ধারণা।

আমি খুঁজে কামাল উদ্দিনের বাসা বের করলাম এবং তার স্ত্রীকে (যতদূর মনে আছে তার নাম হাসিনা) আমি আপা বলে সম্বোধন করলাম। নিয়মিত তাদের বাসায় গিয়ে খোঁজ-খবর রাখতাম এবং বাজার বা অন্য কোনো কাজে প্রয়োজন হলে সব সময় আমি তাদের সঙ্গে আছি, এটা আমি তাদের জানালাম। আমি ৩-৪ দিন পর বুঝতে পারলাম, হাসিনা আপা আমাকে নিজের ছোট ভাই হিসেবে মনে করেন। এ অবস্থায় আমি একা একদিন আপাকে বললাম, মূলত বঙ্গমাতার নির্দেশেই আমি আপনাদের খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছি। আপা একটু হাসলেন, হাসি থেকে বুঝতে পারলাম, বঙ্গমাতার সঙ্গে তার যোগাযোগ আরও বেশি আছে। তিনি এজন্য এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেননি।

বঙ্গমাতা সরাসরি আমাকে না বললেও আমি বুঝেছিলাম, আমার কামাল উদ্দিনের পরিবারের নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়ার সঙ্গে একটি দায়িত্ব ছিল, কামাল উদ্দিন এত অত্যাচারিত হওয়ার পরও আবার সরকারের পক্ষে চলে যায় কিনা, তা বোঝার চেষ্টা করা। হাসিনা আপা অত্যন্ত কঠিন ধরনের নারী ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে ছিলেন অন্ধভক্ত। এই বাসায় এক কিশোরীকে দেখতে পাই। কিশোরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে আলাদাভাবে বলেন, সে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষের এক সাক্ষীর মেয়ে। তবে তিনি এও বললেন, এই সাক্ষী বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে কোনো সাক্ষী যেন না দেয়, সে ব্যাপারে তিনি সফলতা অর্জন করার চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বললেন, এই কিশোরী চাষী নজরুল ইসলামের বান্ধবী এবং কিশোরীর পিতা-মাতা তাদের দু`জনের বিয়ের ব্যাপারে আপত্তি করেছে। তিনি এ বিষয়টিকে এমনভাবে ব্যবহার করছেন, যাতে করে বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে সাক্ষী বঙ্গবন্ধুর জন্য ক্ষতিকারক না হয়। আমার তখন সরাসরি চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ না হলেও আপা আমাকে জানিয়েছিলেন, চাষী নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর একজন ভক্ত।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সরকার সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান না করা পর্যন্ত আমি কামাল উদ্দিন ভাইয়ের পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়েছি। বঙ্গমাতার সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করতে গেলে তিনি জানিয়েছেন যে, সব বিষয়ে তিনি অবগত আছেন। আমাদের বুঝতে হবে, কঠিন সময়ে কাকে দিয়ে কীভাবে কাজ করেছে তা একজনের সঙ্গে আরেকজনের জানা সম্ভব ছিল না। সুতরাং ভবিষ্যতে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বঙ্গমাতার অবদান যেটুকু যে জানে, তা লিখে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। শেষ কথা হিসেবে বলতে চাই, বঙ্গমাতা এই দেশের গণআন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার জন্য যে অবদান রেখেছেন, জাতি এখন পর্যন্ত বঙ্গমাতাকে যেটুকু মূল্যায়ন করা প্রয়োজন সেটুকু করতে ব্যর্থ হয়েছে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭