ইনসাইড থট

সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ও আগামী প্রজন্ম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 29/09/2017


Thumbnail

সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেই আলোকিত মানুষ গড়া সম্ভব। সকল প্রকার অপশক্তিকে প্রতিহত করার অন্যতম উপায় হল সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা। তাই  সকল প্রকার অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সংস্কৃতি চর্চার কোন কিল্প নেই। অনেক রস বৈচিত্রে পরিপূর্ণ আমাদের মাতৃভুমি বাংলাদেশ। অজস্র গ্রামগঞ্জ গাঁথা আমাদের এ প্রিয় দেশ। সহজ সরল গ্রাম্য মানুষের আচার আচরণ অভ্যাস স্মৃতি সংস্কার কুসংস্কার-রিদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্যের রূপকথা দ্বারা নির্মিত আমাদের মাতৃভুমি বাংলাদেশের প্রকৃত পরিচয়। আমাদের শেকড় সংস্কৃতি ছাড়া দেশের ইতিহাস পরিপূর্ণতা দাবি করতে পারে না। তাই অকৃত্রিম ও সকল ইতিহাসের মাতা আবাহমান গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতিকে জানা প্রয়োজন। আমাদের দেশের অর্ন্তদৃষ্টি মেলে জানতে হলে তার গ্রামীন মানুষ, তার ভাষা সাহিত্য, লৌকিক শিল্প প্রকৃতি, তার গ্রামীন সমাজকে অবশ্যই বাস্তব দৃষ্টিতে অকপটে নিরীক্ষণ করা চাই।  ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনগোষ্ঠীর নৃতাত্বিক বৈশিষ্টের পটভুমিতেই আমাদের গ্রামীন জীবন বিবেচ্য। লৌকিক প্রতিবেশে লোকজীবনের ভাষা সাহিত্য সংগীত নৃত্যনাট্য, শিল্প, ধর্ম বিশ্বাস, উৎসব পার্বণ ইত্যাদি বহু বিচিত্র অভিব্যক্তি যুক্ত এবং আদি পল্লীজীবন ও আরণ্য জনপদই সেই আবাহমান সংস্কৃতির শেকড়ের লালন ক্ষেত্র। বোধকরি মানুষ ও তার পারিপার্শি¦ক বিচিত্র ও সচেতন সহযোগিতার ব্যাপার নিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক জগত। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল কৃষিপ্রধান দেশের শতকরা ৭০ জন লোকই ক্ষেতখামার করে জীবিকা নির্বাহ করে। নিতান্ত অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত যারা তাদের অধিকাংশ বাংলার পল্ল¬ীতে কৃষি ও অন্যান্য সামান্য ছোট কাজকর্ম করে জীবিকা চালায়। গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের সিংহভাগ লোকই  বর্হিজগতের সুন্দর সুশিশিক্ষিত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত। তবু আছে তাদের জীবনচর্যা, জীবনের সুখদু:খ, সমাজ ধর্ম দেহ মনের বিবিধভাবনা। আর এরই ফলশ্রæতি  হল আমাদের গ্রাম বাংলার আবাহমান সংস্কৃতি। সত্যি বলতে কি! আমাদের পুরো দেশটাই হল গ্রামীন সাংস্কৃতির দেশ। এদেশ লোক সাহিত্যের দেশ, এখানে রয়েছে ভাটিয়ালীর ভাটির স্রোতের গান, শ্বাশত বাংলার ফসল তোলার গান, নানারকম লোকজ উৎসব। নগরজীবনেও আমাদের সুস্থ্য সংস্কৃতির বাস্তব প্রতিভাস একেবারে অনুপস্থিত নয়। কাজের তাগিদে বাংলাদেশের পল্লির সাধারণ অনেক মানুষই শহরের গন্ডিবদ্ধ জীবনে বাস করতে বাধ্য। মুচি, মেথর, ডোম, কুলিকামিন, শ্রমিক, মজুর, রিক্সাওয়ালা, অশিক্ষিত অমার্জিত দোকানদার, হকার ইত্যাদি শ্রেণির লোক কিন্তু গ্রামের আবেষ্টনী থেকে বিচ্যুত হলেও তাদের মনমেজাজে চিন্তা চেতনায় গ্রামীন প্রতিবেশের উপর নির্ভরশীল। তাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য অনুযায়ী তারা নগর জীবনের পাশাপাশি গ্রামীন সাংস্কৃতিক জীবনের বিবিধ ভাব প্রদর্শন করতে সর্বদাই উন্মুখ। এদিক থেকে গ্রাম বাংলার আবাহমান সংস্কৃতিক জীবনের নানা প্রতিচ্ছবির আনাগোনা আধুনিকতম শহুরে জীবনেও অনেকখানি উপস্থিত বলে প্রতিয়মান হয়। তবু ও আমাদের দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মের নামে বিভিন্ন সন্ত্রাস চলছে প্রতিনিয়ত। সন্ত্রাস ,জঙ্গিবাদ, ও মানুষ হত্যা, সারা বিশ্বে এখন আতঙ্কের বিষয়।

একটি দেশের অন্যতম চালিকাশক্তি হল সে দেশের আগামী প্রজন্ম। এই  প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের আগামী প্রজন্মকে সুস্থ্য সাংস্কৃতিক মূলধারায় আনা প্রয়োজন । তাই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে দেশে একটি সাংস্কৃতিক গণজাগরণ তৈরি করতে হবে। জেলা-উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমি-শিশু একাডেমিগুলো এখন ঘুমুচ্ছে, এদের জাগিয়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী কমিটি থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব স্থানে জঙ্গিবাদ নিয়ে  বৈঠক হতে পারে সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করে নজরদারি বাড়াতে হবে। মসজিদ বা নামাজের স্থানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কোনো গোপন সভায় মিলিত হতে পারবে না। শিক্ষার্থীরা অনিয়মিত হলে অবশ্যই অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। লাইব্রেরিতে জঙ্গিবাদের কোনো বই-পুস্তক থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মসূচিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে হবে।  একাডেমিক কার্যক্রমেও জঙ্গিবাদবিরোধী বিষয় থাকতে হবে এখানে এথিকস ও নন্দনতত্বের মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।  নিয়মিতভাবে বাঙালি/জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক চর্চা থাকতে হবে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে পুলিশকে জানাতে হবে। অপরাধে জড়িত বলে সন্দেহ হলেই কাউন্সিলিংয়ের আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসবাদবিরোধী গবেষণা হতে হবে।  উল্লেখ্য, জঙ্গিবাদ আজ আর কোনো দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা নয়, এটি এক বৈশ্বিক সমস্যার রূপ নিয়েছে। তাই বিশ্বনেতারা মনে করছেন, জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটনে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক উদ্যোগও জরুরি বিবেচিত হচ্ছে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। স¤প্রতি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বেনাপোল-পেট্রাপোল সমন্বিত চেকপোস্টের উদ্বোধনকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের মাননীয়  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে ‘জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আপনি নিজেকে কখনো একা ভাববেন না। ভারত সব সময় পাশে থেকে আপনাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাবে।’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সাধ্যমতো সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। অনেক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উদ্যোগের চেয়েও আঞ্চলিক উদ্যোগ অনেক বেশি কার্যকর হয়। দেখা গেছে, কোনো একটি ঘটনা ঘটিয়ে এক দেশের অপরাধীরা আরেক দেশে গিয়ে আত্মগোপন করে। জঙ্গিরা যাতে এভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে তার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তা ছাড়া জঙ্গিদের অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ রোধ করতেও দুই দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে বেনাপোলের আধুনিক চেকপোস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এখানে এমন সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, যাতে লুকিয়ে অস্ত্র আনার সুযোগ খুব কমই পাওয়া যাবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আরো আটটি স্থলবন্দরে দ্রæত আধুনিক চেকপোস্ট স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া অরক্ষিত সম্পূর্ণ সীমান্ত সুরক্ষিত করতে হবে, যেন কোনোভাবেই অস্ত্র ও বিস্ফোরকের চালান দেশে না ঢুকতে পারে। শুধু ভারত নয়, মিয়ানমারের সঙ্গেও একই ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের জঙ্গিরা রিক্রুট, প্রশিক্ষণ ও অর্থ সংগ্রহে মালয়েশিয়াকে ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর যেমন কঠোর ভূমিকা নিয়েছে, তেমনি কঠোর ভূমিকা যেন মালয়েশিয়ার সরকারও নেয়, সে জন্য তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। একইভাবে আলোচনা চালাতে হবে প্রতিবেশী অন্য দেশের সঙ্গেও।

কারণ একটাই, আমরা কোনোভাবেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার দেখতে চাই না। এ জন্য সরকারের ওপর দায়িত্ব হয়ে গেছে, সন্ত্রাসের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের প্রতিহত করা । একজন সংস্কৃতবান মানুষ কখনো জঙ্গি তৎপরতা কিংবা মানুষ হত্যা ও সন্ত্রাসী কাজে অংশ নিতে পারে না। বরং সে সমাজের আলোকিত মানুষ হিসেবে এগিয়ে আসে সমাজের সাধারণ মানুষের জন্য। তাই, জঙ্গিবাদ, মানুষ হত্যা, হানাহানি, কাটাকাটি বন্ধ হবার সময় এখনই। একটা জাতির মানবিক গঠনের পেছনে তাই আবাহমান সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। এই অস্থির সময়ে আমাদের আগামী প্রজন্মকে  তাই সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাদের গড়ে তুলতে হবে আলোকিত মানুষ হিসেবে।

লেখক  সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭