ইনসাইড থট

ফৌজদারি কার্যবিধিতে দণ্ড স্থগিতকরনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দণ্ডিত ব্যক্তির বিদেশ যাওয়া: আদৌ সম্ভব কিনা?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 09/05/2021


Thumbnail

সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরিবার থেকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসা দিতে বিদেশ (বাংলাদেশের বাইরে) নিতে মানবিক কারনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নিকট আবেদন করা হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার আন্তরিকতা দেখালেও শেষ পর্যন্ত আজকে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনগত সুযোগ না থাকায় আইনমন্ত্রনালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে উক্ত বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা সংক্রান্ত দরখাস্তটি না মঞ্জুর করেন, এতে দন্ডিত আসামীদের দন্ড স্থগিত অবস্থায় বিদেশ যাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এইবার আসি আইনগত বিষয়ে:

সাধারনত দন্ডিত আসামীদের দণ্ড স্থগিত, মওকুফ, আংশিক মওকুফ বা কমানোর বিষয়টি বর্ণিত আছে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে, এই আইনটি আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত আদি আইন বা মূল আইন। এইবার আসি দণ্ড স্থগিতকরন সম্পর্কিত বিধানটি রয়েছে এই আইনের ৪০১ ধারায়। প্রথমেই বলে নেই এই আইনটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রযোজ্য এবং বাংলাদেশের সীমানার বাইরে যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের কোন কর্তৃত্ব নাই তাই এই আইনটি শুধু বাংলাদেশের সীমানার ভিতরেই প্রযোজ্য {ধারা- ১(২)}। এই আইনটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফৌজদারি বিচার বা তদন্ত সম্পর্কিত প্রতিটি নাগরিক বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদেশী নাগরিকদের উপরও প্রযোজ্য।

এই আইনটি বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি দেশের বাইরে গিয়েও কোন অপরাধ করে থাকে তাঁর উপর প্রযোজ্য অথবা বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড কোন জাহাজ যা অন্য কোন দেশের জলসীমার উপর অবস্থিত, বা বিমান যা অন্যদেশের আকাশে বা বন্দরে থাকা এর ভীতর কোন অপরাধ সংগঠন করে থাকে তবে তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, তাদের এইদেশেই বিচার করা সম্ভব এবং তাদের এমন ভাবে বিচার করা হবে যেন তারা উক্ত অপরাধটি বাংলাদেশের সীমারা ভিতরেই সংগঠন করেছেন ( ধারা-৪, দন্ডবিধি, ১৮৬০, তৎসহ ধারা- ১৮৮,১৮৯ ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮)। এবং এই আইনে কোন অপরাধীকে বিচারের জন্য অন্য দেশের হাতে তুলে দেয়া বা অন্য দেশে পালিয়ে যেতে অথবা বিচার বা দণ্ড এড়ানোর সুযোগ করে দেয়ার সুযোগ নাই।

৪০১ ধারার উপধারা- ১ এ বলা হয়েছে:

# কোন ব্যাক্তি যিনি আদালত কর্তৃক দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন সরকার চাইলে তাঁর দণ্ড স্থগিত, মওকুফ বা কমিয়ে দিতে পারেন।

# এইক্ষেত্রে চাইলে সরকার শর্ত আরোপ করতে পারেন অথবা শর্তহীনও হতে পারে তবে সরকার যদি কোন শর্ত আরোপ করে সেইটা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট আসামীকে মানার ঘোষনা দিতে হবে, মানতে না চাইলে তাঁর আবেদন বাতিল হয়ে যাবে। 

তবে সরকারের দণ্ড স্থগিত, কমানো বা মওকুফ সংক্রান্ত এই বিধানটি সরকারের একছত্র নয়, এই ধারার ক্ষমতাটি প্রয়োগ করতে হলে সরকারকে অবশ্যই ফৌজদারি কার্যবিধির অন্যান্য ধারা সমূহের আলোকে প্রয়োগ করতে হবে এবং পাশাপাশি ৪০১ ধারার উপধারা ২-৫ তে বর্ণিত পদ্বতি অনুসরন করতে হবে।

আমার মতে ৪০১ ধারা মতে দন্ড মওকুফ, স্থগিত এবং কমানো সংক্রান্ত সরকারের ক্ষমতাটি একচ্ছত্র নয়, এই ক্ষেত্রে সরকারকে দেশীয় আইন, সংবিধান, পথা (কাস্টমস) সর্বোপরি ন্যায়নীতি এবং সুবিবেচনার উপর নির্ভর করতে হয়। এই বিষয়গুলো কেন আসছে? তাঁর একটাই কারন সরকারের কাছে এই সংক্রান্ত দরখাস্ত আসলে তা সরকারকে অবশ্যই ৪০১ (২) ধারা মতে দণ্ড প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট বিচারকের কাছে তাঁর মতামতের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং উক্ত বিচারক অবশ্যই এই আবেদনটি নিষ্পত্তিতে দেশীয় আইন, সংবিধান, পথা (কাস্টমস) সর্বোপরি ন্যায়নীতি এবং সুবিবেচনার উপর নির্ভর করে মতামত দিবেন, বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রনালয় বিচারকের মতামত নিয়ে দিয়েছেন কিনা আমি বলতে পারছিনা হয়তো তারা এইটা নিয়েছেন। এবং মতামত যদি নেতিবাচক আসে উক্ত দরখাস্ত মঞ্জুর করার কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করিনা। এবং বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই।
 
বেগম খালেদা জিয়া একজন দন্ডপ্রাপ্ত জেলে অন্তরীন একজন কয়েদী, তাঁর বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করা আবেদন না মঞ্জুর হওয়াটা অবশ্যই যৌক্তিক এবং আইনগত ছিল কারনঃ 

# তাঁর মুক্তির ক্ষেত্রে সরবোচ্চ আদালতের নেতিবাচক দৃষ্টি ভংগী ছিল, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ তাঁর জামিনের আবেদন কয়েকবার নামঞ্জুর করেছেন।

# সরকার একবার তাঁর ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ সুবিধা দিয়ে দুইটি মামলায় আরোপিত তাঁর সাজা স্থগিত করেছেন এবং একই ব্যাক্তির ক্ষেত্রে ৪০১ ধারার পুনরায় সুবিধা দেয়ার সুযোগ নাই। 

# সরকার বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করেছেন এবং দণ্ড স্থগিত অবস্থায় একজন জেলে অন্তরীন কয়েদীর বিদেশ যাওয়ার কোন সুযোগ আইনে নাই, এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে হলে একটাই পথ আছে সেইটা হলো খালেদা জিয়ার দুই মামলায় আরোপিত সাজা মওকুফ করে দেয়া, বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদীর সাজা মওকুফ করে দেয়া কার্যত বে আইনী হবে কারন, উক্ত সাজা ছিল একজন প্রধানমন্ত্রীর বিরদ্বে দুর্নীতির মতো নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ, যা একটা জাতির জন্য লজ্জার এবং শুধুমাত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিবেচনায় সাজা মওকুফ করার বিষয়টি সমাজে ঠিক ম্যাসেজ দিবেনা। 

# বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্বে মোট মামলার সংখ্যা হলো ৩৪ টি, দুটি মামলায় তিনি দন্ডপ্রাপ্ত হলেও মূলত তাঁর বিরুদ্বে আরও ৩২ টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে, এখন তাঁর দণ্ড মওকুফ করা হলে তাঁর বিরুদ্বে থাকা বাকী ৩২টা মামলার বিচার অনিশ্চিত হয়ে যাবে।

# এমনকি সরকার যদি তাঁকে এই দুটি মামলায় আরোপিত দণ্ড মওকুফ করেও থাকেন তারপরও তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না, প্রথমত তাঁর পাসপোর্ট এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে এবং এই পাসপোর্ট নবায়ন করতে গেলে অবশ্যই পাসপোর্ট সম্পর্কিত আইন অনুসরন করেই তাঁর পাসপোর্ট নবায়ন করতে হবে সেইক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্বে থাকা ৩৪ টি মামলার রেকর্ড তাঁর পাসপোর্ট নবায়নে বাঁধা হতে পারে। 

#  সরকার যদি তাঁকে এই দুটি মামলায় আরোপিত দণ্ড মওকুফ করেও থাকেন তারপরও তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না কারন তাঁর বিরুদ্বে থাকা বাকী ৩২ টা মামলায় তিনি জামিন না পেয়ে থাকলে বা উক্ত ৩২ টি মামলাতেই তাঁকে জামিন নিয়ে তবেই বিদেশে যেতে হবে।

# সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যেও কোন দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদীর দন্ড স্থগিত অবস্থায় বিদেশে যাওয়ার কোন নজীর এই দেশে নাই, সুতরাং তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করাই আইনসিদ্ব ছিল।
 
সুতরাং এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ৪০১ ধারা মতে দণ্ড মওকুফ করা ছাড়া শুধুমাত্র সাজা স্থগিত থাকা অবস্থায় একজন দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদীর কোন অবস্থাতেই বিদেশ যাওয়া সম্ভব নয়।

লেখক: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭