ইনসাইড থট

রোজিনার মুক্তি চাই না

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 18/05/2021


Thumbnail

গত কয়েকবছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে মনে রাখার মত যে কটি রিপোর্ট হয়েছে, তার বেশিরভাগই রোজিনা ইসলামের করা। বাংলাদেশের একজন রিপোর্টারের পক্ষে যে কটি পুরস্কার জেতা সম্ভব, রোজিনা তার সবগুলো জিতেছেন, বারবার জিতেছেন। এ সবই তার অর্জন, কঠিন পরিশ্রমের ফল। দেখা হলেই বলতাম, ট্রফি তো তারা দেয়, রাখার শো কেস তো নিশ্চয়ই দেয় না। লাগলে বইলেন, বানিয়ে দেবো। এত ট্রফি রাখবেন কই? রোজিনা খালি হাসতো, বলতো, দোয়া কইরেন। আমি বলতাম, ট্রফিগুলো সাজিয়ে রেখে চেকগুলো দিয়ে দিয়েন। আমি প্রথম আলো ছাড়ার পর রোজিনা যোগ দিয়েছে। তাই তার সাথে বাজ করার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু তার সাহস দেখে আমিই ভয় পেয়ে যেতাম। মন্ত্রী, এমপি, আমলা, মাস্তান, প্রভাবশালী- কাউকেই ছাড়তেন না। তার একেক রিপোর্টে কত জনের আরাম হারাম হয়ে গেছে, কত জনের জমানো স্বর্ণ তামা হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। আমি বলতাম, বইন, এত সাহস পান কই? হাসতে হাসতে বলতেন, আপনেরা ভাইয়েরা আছেন না। রোজিনার সব আদিখ্যেতা তার মেয়েকে নিয়ে। করোনার কারণে দুই জন্মদিনের পার্টি হয়নি। নইলে মেয়ের জন্মদিনে হইচই করা তার স্বভাব। রোজিনার মেয়ে কী গান গায়, কী আবৃত্তি করে; ফেসবুকের সুবাদে সব আমাদের জানা। আমার স্ত্রী মুক্তিও রোজিনাকে খুব পছন্দ করে। সন্ধ্যা থেকেই বারবার ফোন, রোজিনার কী খবর, সাংবাদিকরা কী করছে? মুক্তি ভেবেছিল, ঝামেলা মিটে যাবে। কিন্তু যখন জানলো রোজিনাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে গেছে, আপাতত সেখানেই থাকতে হবে; মুক্তি পাগলের মত হয়ে গেল- মেয়েটাকে ছাড়া রোজিনা থাকবে কীভাবে? আলভিনাই বা মায়ের হেনস্থার এই ছবি দেখে মাকে ছাড়া থাকবে কীভাবে?

রোজিনা ইসলাম প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার। অফিসের বাইরে তার কাজের ক্ষেত্র সচিবালয়। অফিস-বাসার চেয়েও জেগে থাকার বেশি সময় তার কাটে সচিবালয়ে। সেখানেই তাকে ছয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকতে হলো, মার খেতে হলো, অসুস্থ হওয়ার পরও হাসপাতালে না পাঠিয়ে পাঠানো হলো থানায়। এই তবে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার পুরস্কার। রোজিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সরকারি নথি চুরি করেছেন বা ছবি তুলেছেন। আসলেই চুরি করেছেন কিনা জানি না। যদি করেও থাকেন, প্রিয় আমলারা, রোজিনা ব্যক্তিস্বার্থে করেননি, সাংবাদিকতার জন্য করেছেন। আর সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়। সচিবালয়ের নথি চুরি নয়, রোজিনার আসল অপরাধ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির পুকুর চুরির খবর ফাঁস করে দেয়া। বেশি পেছনে যেতে হবে না, গত একবছরের প্রথম আলোর পাতায় পাতায় রয়েছে রোজিনার আসল `অপরাধ`এর ফিরিস্তি। শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন রোজিনা একাই।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ঘুম হারাম করে দিতো রোজিনার রিপোর্ট। রোজিনা এমনভাবে লিখতো, কোনো ফাঁক থাকতো না, ধরা যেতো না। তাই তো সবাই তক্কে তক্কে ছিল। স্বর্ণের মধ্যে ভেজাল মিশিয়ে দাও ক্ষতি নেই, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভারেরও নাকি হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকের হাজার কোটি মেরে দাও কিচ্ছুটি হবে না। কিন্তু রিপোর্টের প্রমাণ হিসেবে তুমি নথি চুরি করেছো কি মরেছো। আচ্ছা মহা দাপুটে আমলা স্যারেরা (স্যার না ডাকলে তারা আবার মাইন্ড করেন) নথি চোর ধরার পর তো আপনাদের দায়িত্ব পুলিশ ডেকে তাকে সোপর্দ করা এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে মামলা করা। সেটা না করে আপনারা কেন তাকে ছয় ঘণ্টা তাকে আটকে রাখলেন, কেন তাকে মারধোর করলেন, অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা কোন আইনে তার গলা টিপে ধরলেন? ধরে নিচ্ছি রোজিনা কেউ না, সাংবাদিক না, রিপোর্টার না; বাংলাদেশের একজন সাধারন নাগরিক, একজন নারী। তাহলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলারা কোন আইনে একজন নারীকে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখলেন?

রোজিনাকে শাহবাগ থানায় নেয়ার পর আমি তার মুক্তি চেয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই চাওয়া অর্থহীন, সুন্দরবনের গভীরে দাড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদার মত। মন হালকা হবে, কিন্তু কেউ শুনবে না, কোনো কাজ হবে না। যারা অন্যায়টা করেছে, তাদের কাছে প্রতিকার চেয়ে লাভ কী? আর সাংবাদিক হলেই তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না, তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না; এমনটাও আমি মনে করি না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানীর দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হবে। আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। আমার বোন, আমাদের বোন রোজিনার থানা হাজতে বা কারাগারে থাকতে কষ্ট হবে জানি, তবু আমলা নিয়ন্ত্রিত এই সরকারের কাছে রোজিনার মুক্তি চাই না। দেশের প্রথম সারির দৈনিকের একজন সিনিয়র রিপোর্টারকে সচিবালয়ে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখেছে; আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী সে খবর পাননি? তারা কী করেছেন? মামলা পর্যন্তু তারা কী করলেন? এথন আর মুক্তির দাবি করে লাভ কী। তারচেয়ে ভালো আইন নিজের গতিতে চলুক।

তবে যারা দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়কে ছয় ঘণ্টার জন্য হিন্দি সিনেমার টর্চার সেল বানিয়ে ফেললেন যিনি রোজিনাকে গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছেন, মুক্ত সাংবাদিকতার গলা টিপে ধরেছেন; তাদের প্রত্যেকের বিচার চাই। সচিবালয় কারো মাস্তানি করার জায়গা নয়। রোজিনা নথি চুরি করেছেন কি করেননি, সেটা আদালতে প্রমাণ হবে। আইন নিজের গতিতেই চলবে। কিন্তু একজন নারীকে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে যারা মারাত্মকভাবে আইন ভঙ্গ করলেন, তাদের আইনের আওতায় আনা না হলে ভবিষ্যতে শৃঙ্খলা থাকবে না। সবাই সচিবালয়কে মাস্তানদের আখড়া ভাববে।

অভিযুক্ত নথি চোর রোজিনা থানায় আর হাজার কোটি টাকা লুট করা দুর্বৃত্ত, ব্যাংক সাবার করে দেয়া ব্যবসায়ী, ঘুষখোর আমলারা আরামে বাসায় ঘুমাচ্ছে। এমনকি একলা একজন নারীর সাথে যারা বেআইনীভাবে মাস্তানি করলো তারাও নিশ্চয়ই, রোজিনাকে খুব শায়েস্তা করা গেছে ভেবে, নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। তবে আইন হাতে তুলে নেয়া এই মাস্তানরূপী আমলাদের প্রত্যেকের বিচার চাই। ছয় ঘণ্টা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কী হয়েছিল, তা তদন্ত করে বের করতেই হবে।

রোজিনা এত লোকের বারা ভাতে ছাই দিয়েছেন, সুযোগ পেয়ে তারা নিশ্চয়ই এখন প্রতিশোধ নেবেন। শুরুতে আমি রোজিনার পুরস্কারের কথা বলছিলাম। তবে আমি মানি, এই যে মামলা, এটাই তার সাংবাদিকতার বড় পুরস্কার। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার, সাধারন মানুষের ভালোবাসা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে হাহাকার, মানি সেটাই রোজিনার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

রোজিনা বোন আমার, তুমি ভয় পেও না। তুমি সবটা দেখোনি, কিছুটা নিশ্চয়ই দেখেছো। কত মানুষ সচিবালয়ে, থানায়, ফেসবুকে তোমার জন্য স্লোগান দিচ্ছে, মুক্তি চাইছে। আমি একজন ব্যক্তি রোজিনার মুক্তি চাই না। আমি চাই, আমি চিৎকার করে বলবো, কিন্তু কাজী জেবুন্নেসার মত কেউ আমার গলা টিপে ধরবে না। আমি চাই, গণমাধ্যম মুক্তি পাক। সেই মুক্তির পথ ধরে রোজিনা আরো সাহসী হয়ে, আরো অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে, আরো ধারালো হয়ে বেরিয়ে আসুক। আমরা সবাই সাহসী সাংবাদিকতার পাশে আছি, আমরা রোজিনার পাশে আছি।

১৮ মে, ২০২১



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭