ইনসাইড আর্টিকেল

নাচোলের রানী ইলা মিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 13/10/2017


Thumbnail

‘জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান/মাতা ভগ্নি ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহিয়ান’

কাজী নজরুল ইসলামের এই লেখাই প্রমাণ করে দেয়, পৃথিবীর প্রত্যেকটি সাফল্য, প্রত্যেকটি বিজয়, প্রত্যেকটি সৃষ্টির পেছনে নারীর অবদান কোনো না কোনো ভাবে আছেই। পুরুষ শাসিত এই সমাজে যেখানে নারীরা সর্বদাই অবহেলিত, সেখানে আজ দেশের নেত্রী একজন নারী, বিরোধীদলিয় নেত্রীও নারী। মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ পদেও নারীরাই কর্তার আসনে বসে আছেন।

কিন্তু এক সময় নারীর এই ক্ষমতায়ন তো দূর, নারীদের শিক্ষার কথাও ভাবা সম্ভব ছিলো না। সে সময় নারী আন্দোলনে অগ্রনী ভুমিকা রেখে নারী জাগরনের পথ প্রদর্শন করেন বাঙালি মহিয়সী নারী, তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার আদায়ে সংগ্রামী কৃষক নেত্রী, যিনি বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যিনি স্বেচ্ছায় জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছিলেন, ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। তারপরও থেমে যায়নি যাঁর আদর্শের লড়াই। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে গেছেন এই সংগ্রামী, মহিয়সী নারী।

আজ নারী ক্ষমতায়নে সশস্ত্র সংগ্রামী প্রীতিলতা, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নেওয়া হয়। কিন্তু ইলা মিত্র না থাকলে, আজ হয়তো তাদের নামও নেওয়া হত না। যার ধ্যান-ধারণায় এ দেশে নারীর মানবাধিকার আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, যার অগ্রনি ভুমিকার কারনেই আজ রাজনীতিতে নারীদের আগমন সেই ইলা মিত্রের সংগ্রামী জীবন আজও উজ্জীবিত করে চলেছে এ দেশের নারী সমাজকে।

১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় নাগেন্দ্রনাথ ও মনোরমা সেনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন ইলা সেন। জীবনের শুরুর দিকে একজন নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে ভারতবর্ষের নজর কেড়েছিলেন, এরপর তাঁর ১৯৪৬-৫০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত তেভাগা আন্দোলনে অন্যতম সংগঠক ও নেত্রী হিসেবে ভুমিকা তাকে ভারতবর্ষের কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে।

১৯৩৬ থেকে একটানা ৩ বছর জুনিয়র এথলেটিক্সের বাংলা চ্যাম্পিয়ন ইলা সেন ছিলেন বাঙালি সমাজের নানাবিধ কুসংস্কার দূরীকরনের পথিকৃৎ। চৌদ্দ বছর পর ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ করেন। ছাত্রাবস্থায়ই বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ভুখা মিছিল, খাদ্য আন্দোলন, লঙ্গরখানা পরিচালনাসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে জড়িত ছিলেন।

পরিবারে তিন বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। শৈশবকাল থেকেই তিনি নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সে সময়ে বাঙালি হিন্দু রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে কিংবা বউ হয়ে সে সময় পুরোদস্তুর একজন সমাজসেবী হওয়া খুবই কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু তারপরও ইলা মিত্র সব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে এক ধাপও পিছপা হননি।

ইলা মিত্র যখন সম্মানের ছাত্রী, তখন থেকেই রাজনীতির সাথে তার পরিচয় ঘটে। ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলে, হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে ঐ বছরই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামক সংগঠনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনের এই কাজ করতে করতে তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে বিভিন্ন নারী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৭১ এবং ১৯৭২ সালে তাকে কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক আন্দোলনের অগ্রপথিক।

নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। নারী অধিকার বাস্তবায়নে ইলা মিত্র ছিলেন আশাবাদী। তার মতে, শুধু মহিলাদের সংগঠিত হলেই হবে না, নারী মুক্তির জন্য সমাজ পরিবর্তন করতে হবে। ১৯৫৭ সালে ইলা মিত্র এমএ পাস করে কলকাতায় একটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনি রাজনীতির ওপর একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। অনুবাদকও ছিলেন তিনি।

এরপর, ১৯৪৫ সালে জমিদারপুত্র ও দেশকর্মী কমিউনিস্ট রমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে বিয়ে করেন। বিয়ের পরই ইলা মিত্র তাঁর স্বামীর বাড়ি নবাবগঞ্জের নাচোলে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি সাঁওতালদের নিয়ে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ইলা মিত্র যেসব অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কৃষক-শ্রমিক তেভাগা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

সাঁওতাল বিদ্রোহের শেষের দিকে ইলা মিত্র সাঁওতাল যুবতীর ছদ্মবেশে পালিয়ে যাবার সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের রহনপুর রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর ইলামিত্রের উপর যে পৈশাচিক ও বর্বরোচিত নির্যাতন করা হয়েছিল, ইতিহাসের পাতায় তা জঘন্যতম ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার এই অবদানের কারণে, নারী ক্ষমতায়নের ইতিহাসে এক ক্ষুদ্র বিন্দু হলেও তার নাম ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকবে। নারী জাগরনের পথিকৃৎ হিসেবে আজও তার অবদান, জীবন সংগ্রামের ঘটনা উজ্জীবিত করে চলেছে এ দেশের নারী সমাজকে।

তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিলেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অক্লান্তভাবে সেবা দিয়েছেন।

আজ ১৩ অক্টোবর, ২০০২ সালে এই দিন ৭৬ বছর বয়সে কলকাতায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন নারী আন্দোলনের পুরোধা এই নারীনেত্রী। তবে তিনি এখনও বিরাজ করছেন কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়।

 

বাংলা ইনসাইডার/আরএ/জেডএ






প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭