নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 14/10/2017
আজ হঠাৎ করেই মারিয়ার ইচ্ছে হলো একদম বাঙালি সাজে সাজবে। শাড়ি, মাটির কানের দুল, হাতের বালা, কপালে টিপ। সেজে গুজে ঘর থেকে বেরুতেই মা বলে উঠলেন, ‘কি রে, আজ কি হলো তোর? এভাবে সেজে কই যাচ্ছিস?’ মারিয়া উত্তর দিল, ‘আজ অফিসে একটা অনুষ্ঠান আছে, সবাই বাঙালি সাজে সাজবে, তাই আমিও…’ মা বললেন, ‘তাই তো বলি, হঠাৎ শাড়ি, মাটির গহনা কেন! এসব তো ফেলা বৈশাখ বা ফাল্গুন ছাড়া কেউই পরে না।’
আসলেই, এখন মাটির জিনিসপত্র শুধু বিশেষ দিন গুলোতে, বা বিশেষ কারণেই ব্যবহার হয়। ফলে মৃৎশিল্পের প্রসার ঘটলেও, কিছু কিছু বিশেষ দিন বা কাজেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে বাঙালির ঐতিহ্যমণ্ডিত এই শিল্প।
বাংলাদেশ রূপ বৈচিত্রের দেশ। এদেশে অতীত কাল থেকেই হাজার ধরনের সংস্কৃতি পালন করা হয়। যার একটি নিদর্শন হলো ‘মৃৎশিল্প’। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। ‘মৃৎ’ মানে মাটি আর ‘শিল্প’ মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। তাই মাটি দিয়ে তৈরি শিল্পকর্মকে ‘মৃৎশিল্প’ বলে, এবং যারা এই শিল্পকর্মের সঙ্গে জরিত তাদের বলা হয় কুমার। কুমররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কাজ করে থাকেন। এই শিল্পটি হল বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প যা বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহন করে।
কালের বিবর্তনে, শিল্পায়নের যুগে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এই মৃৎ শিল্প। বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি পরিবর্তন না করা, কাজে নতুনত্বের অভাব, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্য বৃদ্ধি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রী পরিবহনে সমস্যা নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে বাংলার বহু বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা এসব তৈজসপত্রের নানাবিধ সুবিধার কারণে দিন দিন আবেদন হারাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পকর্ম।
এখন বিশেষ বিশেষ সময়ে অনুষ্ঠিত মেলায় দেখা মিলে মাটির এসব তৈজসপত্র। বিশেষ করে বাংলা সালের বিদায় ও বরণ উৎসবে। মেলায় আগতদের হাতে হাতে স্থান পাবে এসব মাটির জিনিস। মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও স্থান করে নেয় এগুলো।
মাটির তৈরি এ শিল্পের অবস্থা জানাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্তরের এক দোকানদার সোহেলের সঙ্গে কথা। তিনি বাংলা ইনসাইডারকে জানান, আগের মত এখন মাটির জিনিসপত্রের তেমন চাহিদা নেই। তবে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে কিছুটা ব্যস্ততা থাকে তাদের। সে সময় চাহিদা অনুসারে মাটির তৈরি হাঁড়ি, হাতি, ঘোড়া, হরিণ, পুতুলসহ নানা পণ্য তৈরির আয়োজন চলে, কিন্তু উৎসব শেষ হলে আগের মত ফুলদানি, আশট্রেসহ অন্যান্য শোপিসে ভরে ওঠে দোকান।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পের ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন বলেন, মাটির জিনি মানুষ একান্তই প্রয়োজনের তাগিদে কেনেন, নাহলে না। তিনি বলেন, বিক্রি কম হওয়ায় তিনি ব্যবসা পরিবর্তনের কথাও ভাবছেন।
তিনি জানান, একটি মাটির তৈরি সরা ৪-৫০ টাকা, মাটির তৈরি ব্যাংক ১৫-১২০ টাকা, হাঁড়ি ১৫-৫০ টাকা, মটকি ৫০০ টাকায়, কলস ১০-১০০ ফুলের টপ ও ফুলদানি ১০-২৫০ টাকা ও দইয়ের পাতিল ৬-১০ টাকায় বিক্রি হয়। একে তো দাম কম, তার উপর বেছা কেনা ও নেই তেমন। এই অল্প আয়ে সালাউদ্দিনের চলে না। তিনি বলেন, ‘পূজায় মাটির হাঁড়ি-পাতিল কাজে লাগে, তাই সেই সময় বেছা-বিক্রি হয় একটু। আবার মিষ্টির দোকানে দইয়ের পাতিল, বাসা বাড়িতে ফুলের টব দিয়া সাজায় মানুষ, তাই চালাইতেই। যেদিন লাভ হইব না একদমই, সেদিন ছাইরা দিমু।’
মাটির পাত্রের ব্যবহার নিয়ে একজন ক্রেতা ইকবার হসেন বলেন, মাটির তৈরি জিনিসপত্র আমাদের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। আমরা এখন প্লাস্টিক, মেলামাইনর তৈরি জিনিসপত্র ব্যাবহার করি।’
বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এই শিল্পে অনেকটা ভাটা পড়লেও নতুন করে মৃৎশিল্পের আর একটি শাখা উন্মোচিত হয়েছে। সেটি হলো নান্দনিক মৃৎশিল্প। এ শাখার মৃৎশল্পীরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন শৌখিনসামগ্রী ও শিল্পকর্ম তৈরি করে থাকেন, ইংরেজিতে একে বলা হয় পটারি শিল্প। এরা টেরাকোটা বা মৃৎফলকে খোদাই করে সুন্দর সুন্দর শোপিস তৈরি করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মূর্তি, অলঙ্কার, নকশি পাত্র, ঘণ্টা ইত্যাদি তৈরি করছেন। ঢাকার অনেক দোকানে এসব শৌখিন মৃৎসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার শাহবাগ থেকে টিএসসি ফুটপথ, মিরপুর ২ স্টেডিয়াম সংলগ্ন থেকে মিরপুর১ রাস্তার পাশ সহ পুরান ঢাকা, নিউমার্কেট, ধানমণ্ডি, ফার্মগেটসহ অনেক জায়গাতেই এসব শৌখিন পণ্যের দেখা মেলে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্তরে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন: ইনফ্যাক্টস-ডু-ম্যান, আড়ং, ব্রাক, হ্যান্ডিক্রাফটস, কুমুদিনী, কারিকা, আইডিয়াস সহ অনেক প্রতিষ্ঠানে পাবেন পছন্দের এসব পন্য। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব কুমার দ্বারা নিত্যনতুন ডিজাইনের মাটির জিনিস তৈরি করছেন। বিক্রয়ের পাশাপাশি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করেও অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু এই শিল্পকে বাচিয়ে রাখতে প্রয়োজন সঠিক নজ্রদারি। সরকারের পক্ষ থেকে কুমার সম্প্রদায়দের সহজ ঋণ,কচামাল প্রদান, ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাহায্য করলে, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
বাংলা ইনসাইডার/আরএ
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭