নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 14/10/2017
এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্পের সংজ্ঞার মতো ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’ ছুটিতে যাওয়া বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশ গেলেন, কিন্তু তাঁর গল্পের শেষ হলো না। এখনো অনেক টুইস্ট বাকি। বিচারপতি সিনহা স্বাভাবিক ভাবে বিদেশ যেতে পারতেন। কিন্তু নিজেই বির্তক উস্কে দিয়েছেন। অসম্পূর্ণ এই বিবৃতি দিয়ে তিনি বিতর্কের ডালপালা মেলার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তার বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম এবং নৈতিক স্খলনসহ ১১ টি অভিযোগের কথা বলেছে।
প্রধান বিচারপতি কে নিয়ে আমাদের প্রথম প্রশ্ন, ২ অক্টোবরের ছুটি কি তিনি স্বেচ্ছায় নিয়েছেন? বিচারপতি সিনহা অস্ট্রলিয়া যাবার আগে সংবাদকর্মীদের আলাপে বা তার লিখিত বিবৃতিতে এসম্পর্কে কোনো ব্যাখা দেননি। তার মানে, ছুটি নিজেই নিয়েছেন। তাহলে প্রথম চিঠিতে তিনি যে অসুস্থতার কথা বলেছেন, তা ছিল অসত্য। দেশের বিচার বিভাগের প্রধান ব্যক্তি কি তাহলে অসত্য কথা বলেছেন? সেক্ষেত্রে তাঁর কি এরকম সাংবিধানিক পদে থাকার নৈতিক অধিকার থাকে?
বিচারপতি সিনহা যদি অসুস্থই না হবেন, তাহলে কেন তিনি বিদেশ যাচ্ছেন। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, তাঁকে জোর করে বিদেশ পাঠানো হয়েছে। তাঁকে যদি জোর করে বিদেশ পাঠানো হয় তাহলে তিনি এরকম বিবৃতি দেন কীভাবে? জোর করে বিদেশ পাঠালে তাঁকে এরকম বিবৃতি দিতে দেওয়া হতো না।
প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন, তিনি বলেছেন রায় নিয়ে তাঁকে সমালোচনায় তিনি বিব্রত। তিনি লিখেছেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস সরকারের একটি মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
বেশ ভালো কথা, কিন্তু বিচারপতি সিনহার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪ কোটি টাকা, তার বাড়ির মূল্য কম দেখানোসহ তাঁর অর্থনৈতিক এবং আয়-ব্যায়ের সামঞ্জস্যহীনতা নিয়ে গণমাধ্যম এবং জনমনে যে প্রশ্ন তাঁর কোনো উত্তর প্রধান বিচারপতি দেলেন না কেন? তাঁর প্রশ্নবিদ্ধ আর্থিক বিষয় আড়াল করতেই ষোড়শ সংশোধনী রায়ের প্রসঙ্গ প্রধান বিচারপতি অযাচিত ভাবে এনেছেন? কারণ একটি রায় নিয়ে পক্ষে, বিপক্ষে নানামত থাকবেই। রায়ের পর রায় নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অভিমান করলেন না খুশি হলেন, তা দিয়ে প্রধান বিচারপতির কি আসে যায়? তিনি তো নিরপেক্ষ। রাগ, অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে রায় প্রদান করবেন। কাজেই কে কি মনে করল তাতে তাঁর কি আসে যায়। ষোড়শ সংশোধনী রায় প্রসঙ্গ এনে তিনি কি রায় নিয়ে চলমান রাজনৈতিক বিতর্ক উস্কে দিতে চাইছেন। বিরোধী দলকে পয়েন্ট দিলেন বিচারপতি সিনহা?
প্রধান বিচারপতির বিবৃতির আসল কারণ পাওয়া গেলো বিবৃতির শেষ অংশে। বিচারপতি সিনহা লিখেছেন,‘ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে। কারণ গতকাল প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই।’ এটাকেই বিচারপতি সিনহা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ মনে করছেন।
‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিল বিষাদে’! প্রধান বিচারপতি তার পছন্দমতো সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসন সাজাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রবীণতম বিচারপতি অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদে এমনটাই বলা আছে। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ পড়লে যে কারোরই সমস্যা হবার কথা নয় যে, প্রধান বিচারপতির সব ক্ষমতা ও দায়িত্ব অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির ওপর অর্পিত। কাজেই, তিনি তাঁর কাজের সুবিধার জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসন ঢেলে সাজাতেই পারেন। এটা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ কীভাবে?
বিচারপতি সিনহার চিঠিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ পেয়েছে। অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হাত দেওয়া বিচারপতি সিনহার পছন্দ নয়। এখানেই বিচারপতি সিনহার বিব্রতের কারণ বোঝা যায়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের আস্থা হারিয়েছিলেন। ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর বিচারপতিবৃন্দ, বিচারপতি সিনহার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছিলেন। ২ অক্টোবর অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা বিচারপতি সিনহার বাসায় গিয়ে তাঁর প্রতি আপিল বিভাগের অনাস্থার কথা জানিয়েছিলেন। এটা বিচারপতিবৃন্দের নিজস্ব চিন্তা ও সিদ্ধান্ত। এতে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্রের একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। আপিল বিভাগের বিচারপতিবৃন্দকে রাষ্ট্রপতি ১১টি অভিযোগের তথ্য ও দলিল দেন। এনিয়ে আপিল বিভাগের বিচারকবৃন্দের প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বিচারপতি সিনহা।
বিচারপতি সিনহা সুপ্রিম কোর্টে একনায়কতন্ত্র চালু করেছিলেন। তার কারণে সুপ্রিম কোর্ট রাজনীতির বক্তৃতার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। আপিল বিভাগের সম্মানিত বিচার্পতি বৃন্দ, এক রকম একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে বিচার বিভাগকে মুক্তি দিয়েছেন। বিচারপতি সিনহা সুপ্রিম কোর্টকে নানা ভাবে বিতর্কিত করেছেন। তিনি তাঁর অমীমাংসিত বিবৃতি এই বিতর্কের পথকে আরও দীর্ঘ করলেন মাত্র।
বাংলা ইনসাইডার/জেডএ
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭