নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 16/10/2017
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিতর্কের রেশ না কাটতে না কাটতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে সরকার। প্রধান বিচারপতির মতোই বিতর্কিত মন্তব্য করে ‘নিরপেক্ষ’ সাজার কৌশল নিয়েছেন সিইসি কে এম নুরুল হুদা।
গতকাল রোববার বিএনপির সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করেন। এছাড়াও সূচনা বক্তব্যে তিনি বিএনপিকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন। তিনি বলেন, বিএনপি সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় করেছে, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ দিয়েছে। র্যাব, দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, আইন কমিশন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সীমা ৩০ বছর করেছে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিশ্চিত ভাবেই বিএনপিকে খুশি করতে এবং বিএনপির ‘আস্থা’ অর্জনের জন্য এমন অযাচিত, অপ্রাসঙ্গিক স্তুতি করেছেন। কিন্তু এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি শুধু মিথ্যাচার করেননি, ইতিহাস বিকৃতি এবং সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কোনো দলকে তৈলমর্দন জরুরি নয়। সিইসি যেসব বক্তব্য রেখেছেন সেগুলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে মোটেও সম্পর্কিত নয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি হলো, নিরপেক্ষতা প্রমাণের জন্য হয় আওয়ামী লীগকে গালি দিতে হবে অথবা বিএনপিকে প্রশংসা করতে হবে। এক শ্রেণির সুশীল ৮০ র দশকে জাতির ওপর এই ভারসাম্য তত্ত্বের ভূত চাপিয়েছিল।
আমার মনে আছে, ৮০ র দশকে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য পত্রিকায় শেখ হাসিনা এবং বেগম জিয়াকে সমান স্পেস দেওয়ার রীতি চালু করে। স্কেল দিয়ে মেপে নিউজ দেওয়া হতো। এমন দিন গেছে শেখ হাসিনা বিরাট জনসভা করেছেন। তখন আমাদের অতি উৎসাহী সৎ সাংবাদিকতার ধ্বজাধারীরা, বিএনপি অফিসে ফোন করে একরকম জোর করে বেগম জিয়ার নামে বিবৃতি বের করতো। পত্রিকায় তা সমান গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো।
সেসময় ‘জাতির পিতা’ ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি ছিল নিষিদ্ধ শব্দ। নব্বই এর দশকে ‘আজকের কাগজ’ বের হলো। পত্রিকার প্রকাশক কাজী শাহেদ আহমেদ এক মিটিং এ প্রস্তাব দিলেন, ‘এখন থেকে পত্রিকায় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখব।’ সবাই রাজি হলাম। পরদিন জ্ঞানী, গুণী সুশীলদের গালাগালি তিরস্কারে কান ঝালাপালা। আমরা যেন সংবাদপত্রের মহান নিরপেক্ষতার স্তম্ভকে কুড়াল দিয়ে কেটে ফেলেছি। তখন বিশাল এক বুদ্ধিজীবী শাহেদ ভাইকে দীর্ঘক্ষণ সাংবাদিকতা শেখালেন, এখন তিনি আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান।
যাই হোক, সেই অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে বাংলাদেশ একটি সহনীয় অবস্থার দিকে এসেছে। জাতির পিতা তাঁর সম্মানের আসনে বসেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। বাংলাদেশে যাঁরাই যে রাজনীতি করুক না কেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করবে, জাতির পিতায় বিশ্বাস করবে- এরকম একটি রাজনৈতিক আবহ বিনির্মানের কাজ বহুদুর এগিয়েছে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা ভর করে। বিশেষ করে, কিছু চেয়ারে এখনো পাকিস্তানি ভুতের আছড় রয়ে গেছে। ওই সব ‘মহান ব্যক্তিরা’ চেয়ারে বসে অনেক জ্ঞান বিবর্জিত কথা বলেন। চেয়ারলোভীরা নিজেকে ঈশ্বরের পরেই ক্ষমতাবান মনে করেন। আর তাঁর ক্ষমতা জাহির করার জন্য তিনি নিরপেক্ষতায় মুখোশ আঁটেন মুখে। তখন তিনি নন, কথা বলে ‘ভূত’। নায়ক হবার জন্য ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে নিজেই খলনায়কে পরিণত হন। আমাদের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে একরকম ভূতে পেয়েছিল। এজন্য তিনি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বলেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কারও একক নেতৃত্বে হয়নি। এবার ভূতে পেয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে। এজন্য তিনি জিয়াকে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন। জিয়া যদি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠাতা হন তাহলে জাতির পিতা কি গণতন্ত্রের হত্যাকারী? মি. হুদার মতে গণতন্ত্রের ঘাতক কে ছিলেন? বহুদলীয় গণতন্ত্র মানে কি তাহলে হ্যাঁ না ভোটের প্রহসন? বহুদলীয় গণতন্ত্র মানে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঘাতক, লুটেরা, গণহত্যাকারীদের রাজনীতির অধিকার? বহুদলীয় গণতন্ত্র মানে ক্যান্টনমেন্টে রাজনৈতিক দলের জন্মগ্রহণ? বহুদলীয় গণতন্ত্র মানে সামরিক পোশাক পরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল? তাহলে জনাব নুরুল হুদা কি নিরপেক্ষ নির্বাচন করবেন না বলাই বাহুল্য ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিনীতভাবে জানাতে চাই, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করার ফলে জিয়া একজন অবৈধ ক্ষমতা দখল করা স্বৈরশাসক ছাড়া আর কিছুই নন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাকে খুশি করতে ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন, আমরা জানি না। কিন্ত এটা বুঝি তাঁর একটা মতলব আছে। আর তাঁর মতলবের সঙ্গে বিচারপতি সিনহার মতলবের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি, চারিদিকে নানা চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলছে। আর এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, সরকারের ভেতর থেকে। ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে কোনো পদে বসাতেই তিনি পাল্টে যাচ্ছেন । নিরপেক্ষতার ভড়ং ধরছেন। ভূত তাড়ানোর জন্য যে শষ্য তাতেই ভূত বাসা বাঁধছে। এরা কতটা নিরপেক্ষ আর কতটা ষড়যন্ত্রকারী তা দেখার জন্য কি খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে?
বাংলা ইনসাইডার/জেডএ
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭