ইনসাইড আর্টিকেল

আলো হাতে লাইটার ইয়ুথ ফাইন্ডেশন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/10/2017


Thumbnail

চা শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা নিমাই রায়। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে  দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধ করেছিলেন চার নম্বর সেক্টরে কাশিনগর, লোহাউনি বাগান ও শমসের নগরে। দেশ শত্রুমুক্ত হবার পর আবার চা বাগানের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। এখানে প্রতিদিন ৭০ টাকা আর সপ্তাহে সাড়ে তিন কেজি চাল জুটত তাঁর। এই আয়ে ছয় জনের পরিবারে এক বেলা খেলে দুই বেলা উপোস দিতে হতো।যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট আর প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই মিলেনি তাঁর। আরেক মুক্তিযোদ্ধা  সফর আলী । জীবনের তাগিদে রিকশা চালাতেন। কিন্তু হঠাৎ প্রায় পঙ্গু হয়ে যায় তাঁর ডান  হাত। ফলে রিকশা চালানোর সামর্থ্যও আর রইলো না। তেমনি দেশ স্বাধীন করলেও নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না অজিত রঞ্জনের। এমন অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছে লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশন নামে তরুণদের একটি সংগঠন।তারা অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের গড়ে দিয়েছেন মুদি দোকান বা ঘর। হাতে তুলে দিয়েছেন চিকিৎসার খরচ। সহায়তা করছেন বন্যাদুর্গত ও শীতার্ত মানুষদের।আবার স্কুলে শহীদ মিনারও গড়ে দিয়েছেন। ‘লাইটার ব্লাড উইং’নামে তৈরি করছেন রক্তদাতাদের নেটওয়ার্ক।



ভাবনার শুরু
২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে লাইটার ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির উদ্যোক্তা মুক্তার ইবনে রফিক জানালেন, একসঙ্গে কাজ করার ভাবনা থেকেই সমমনা কয়েকজন ফেসবুকে গ্রুপ খুলে অনলাইনে স্বেচ্ছাসেবি ফরম ছাড়েন। সাড়াও মিলে বেশ। পাঁচ শরও বেশি ফরম জমা পড়ে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে সদস্য সংগ্রহ করেন তাঁরা।লাইটারের বেশির ভাগ সদস্যই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বর্তমান সদস্যসংখ্যা ২৫০ জন। সবাই মাসে ১০১ টাকা করে চাঁদা দেন।তাদের কেউ হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে, কেউ বাবা-মা কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছে চেয়ে, কেউবা আবার ফেসবুকের বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে টাকা তুলেন। তবে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন হলে সবাই সাধ্য অনুযায়ী অনুদান দেন। ইভেন্ট পেজ খুলেও অর্থ  সংগ্রহ করেন তারা।
মিশন ১৯৭১


আনুষ্ঠানিকভাব যাত্রা শুরুর পর সহায় সম্বলহীন মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় লাইটার ফাউন্ডেশন। এটি ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং একটি উদ্যোগ। তারা মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সহায়তায় পাঁচ জন মুক্তিযোদ্ধাক খুঁজে বের করেন। যাঁদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’উপাধি ছাড়া  আর কিছুই নেই! দেখা মিলল সফর আলী, নিমাই রায়, অজিত রঞ্জন, দীপক চক্রবর্তী আর হরেন্দ্র দাশের।জীবনের তাগিদে তাদের কেউ রিকশা চালাতেন, কেউ বা ছিলেন চা শ্রমিক বা দিনমজুর।আবার কেউবা জীবনের শেষ বেলায় এসে বিনা চিকিৎসায় পরিবার পরিজন নিয়ে ধুকছিলেন।লাইটার তাদেরকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, মুদি দোকান দিয়ে, কাউকে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে দিয়ে আবার কারো সন্তানের শিক্ষার ভার নিয়েছে। ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টর, চট্টগ্রামে ১০ জন অসহায় মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নপূরণ করেছে।
মিশন একুশ
শিশু-কিশোরদের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানাতে লাইটার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলে তৈরি করে চলেছেন শহীদ মিনার।২০১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মদনহাটে এম কে রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরি করেছে তারা।আর ২০১৬ সালে শহীদ মিনার বানিয়েছে কেরানীগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।দিনভর সেসব স্কুলে নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের জানিয়েছেন, বায়ান্ন কী? কেন বাংলা ভাষা সঠিকভাবে জানা দরকার। নিজেদের কাছে থাকা পুরোনো বইয়ের কালেকশন নিয়ে করেছেন অনলাইন বই মেলা।এবছর দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে যাওয়া গাইবান্ধার কুন্দেরপাড়ায় একমাত্র মাধ্যমিক স্কুল গণ উন্নয়ন একাডেমির লাইব্রেরীতে চারশো বই দিয়েছে লাইটার ফাউন্ডেশন।
অন্যান্য উদ্যোগ


২০১৪-১৫ সালে গাইবান্ধার এরেন্দাবাড়ি ও সাঘাটায় বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ায় লাইটার। ২০১৬ সালে  জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের পানিবন্দি ৫০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ নিয়ে হাজির হয় তারা।এছাড়া ‘মিশন মডেল ভিলেজের’ আওতায় নীলফামারির প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করেছে।ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এদের কাউকে ব্যবসার মূলধন, কাউকে মুদি দোকান বা গরু দিয়ে সাহায্য করা হয়।

স্বপ্ন অনকে দূরের
সংগঠনের বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর হলেও অজস্র পরিকল্পনা লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের।সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে একটি স্কুল স্থাপন করতে চায় তারা। প্রতিবছর অন্তত ১০টি পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে চায়। দেশজুড়ে স্কুলগুলোতে বানাতে চায় শহীদ মিনার।লাইটার জানে সীমিত সামর্থ্য দিয়ে হয়তো দেশের প্রত্যেক অসহায় মুক্তিযোদ্ধার মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব নয়, তবে স্বপ্নটা ছড়িয়ে দিতে চায় সবার মাঝে।তাঁরা বিশ্বাস করেন অন্ধকার ভেদ করে ‘আলো আসবেই’।লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজ-www.facebook.com/lighterfoundationbd) এবং
ওয়েবসাইট-(www.lighterbd.org)


কতটুকু তারা পেরেছে, কতটুকু পারবে—সেই প্রশ্ন ভবিষ্যতের শিকেয় তোলা রইল। তবে এভাবে লাইটাররা হাতে হাতে ধরে এগোলে অন্ধকারের আগল ভেঙে জাগবে প্রভাত, আলো আসবেই। আলো আসতেই হবে। আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে!


বাংলা ইনসাইডার/জেডএ  




প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭