ইনসাইড থট

এ কেমন চলে যাওয়া! 

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/07/2021


Thumbnail

গতকাল থেকে স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ, বিমূঢ় হয়ে আছি। কিছু লেখার চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হয়েছি। আমার তর্জনীতে সামান্য শক্তিও নেই যে টাইপ করে যাব। রাতে কেমন যেন এক অস্পষ্ঠ দুঃস্বপ্নের ভেতরে ছিলাম। যতসব নিদ্রাতাড়ানিয়া দুর্ভাবনা এসে আমার দু’চোখ দখল করে নেয়। মাঝে মধ্যে এমনটা হয়। এটা জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য বিষয়। 

সকালে সেল ফোনে প্রথম স্পর্শ করতেই দেখি,  ড. সেলিম জাহানের এক বিষাদময় পোস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সময়ের অর্থনীতির শিক্ষক। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক এর মৃত্যুর সংবাদ দিলেন। হঠাৎ কেঁপে ওঠে আমার শরীর, প্রচন্ড ঝাকুনিতে বিছানায় উঠে বসি। বিশ্বাস হচ্ছে না বিধায় বরেণ্য কবি মোহন রায়হানকে ফোন দিই, তিনিও বিস্মিত! বললেন, রাখ, তোমাকে জানাচ্ছি। মোহন ভাইও নিশ্চিত করলেন। দেখি শফি আহমেদ এর লেখা। শফি ভাইও বেদনার্ত এবং  শোকাভিভূত। অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে ডুপডা`র সতীর্থ ও আমার স্নেহভাজনেষু এডভোকেট বাদল খবরটা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ভাবছি,আমাদের একজন অভিভাবক তুল্য মানুষের অকাল প্রয়াণ হল । 

করোনার শুরুর দিকে মুশতাক ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখা পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র শাহবাগে। সঙ্গে তাঁর সেই বন্ধু ড. সেলিম জাহান। স্যারকে এত বছর পরে চিনতে পারি নি। মুশতাক ভাই বললেন, "এই মান্নান সেলিমকে চিন না"?  আমি তাকিয়ে আছি। যেন পুনর্বার পরিচয় এবং অল্প কথা হলো। আমি আশির দশকের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে ( টি এস সি) অনুষ্ঠিত সেই আলোচিত  বিতর্কের বিষয় " তিরিশোত্তর বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়" প্রসঙ্গে বলতেই সেলিম জাহান স্যার বলে উঠলেন, আপনি এখনো কিভাবে মনে রাখলেন? উল্লেখ করা যায়, সে তুমুল জনপ্রিয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শিক্ষক পক্ষে তিনজনের একজন ছিলেন তিনি। করোনা কালে মুশতাক ভাইয়ের সাথে  অনেক বার কথা হয়েছে। তিনি বলতেন, "সেলিম তোমার অনেক প্রশংসা করেছে"। মুশতাক ভাই আমার লেখা নিয়মিত পড়তেন এবং জানাতেন। তিনি তাঁর স্মৃতিধর্মী রাজনৈতিক প্রবন্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বন্ধু শেখ কামাল প্রসঙ্গে লেখাগুলো আমাকে দিয়েছেন। আমিও পড়েছি এবং জানিয়েছি। 

চট্টগ্রামের মানুষ মুশতাক ভাই। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও ব্যাপকভাবে পরিচিত। সেখানকার জেলা প্রশাসক এবং পরবর্তীতে বিভাগীয় কমিশনার থাকার কারনে ওনার সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল। প্রথমবার পরিচয় হয় বাবলু ভাই, জনাব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এর মাধ্যমে। তিনি তাঁর আত্মীয় ও ছাত্র রাজনীতির সহকর্মী, সতীর্থ। পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট এ্যালামনাই এসোসিয়েশন (DUPDAA)`র সাথে আমার সম্পৃক্ততার কারণে এবং এর সভাপতি হিসেবে মুশতাক ভাইয়ের সরাসরি সাহচর্য পেয়েছি, স্নেহসিক্ত উপদেশ পেয়েছি, সর্বক্ষণ হাসিতে ভরে থাকা একজন দীর্ঘদেহী নেতার মুখমণ্ডল অবলোকন করেছি। অভিমান করেও তাঁর যাদুকরী স্পর্শ থেকে দূরে থাকা সম্ভব ছিল না। একদিন আকস্মিক চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার অফিসে হাজির হয়ে  মুশতাক ভাই বললেন," আরে এখানে  আসছিলাম ভাবছি তোমাকে দেখে যাই"। 

অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলেন তিনি, চা খেলেন। আমি অভিভূত। কারণ, বেশ কিছু দিন যাবৎ ডুপডা থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মুশতাক ভাই বললেন, "ঢাকায় আস কিছু করতে হবে"। আমি ঢাকায় এসেছি  বটে, তবে সঙ্গে করে অভিশপ্ত করোনার জীবন নিয়ে। 

আজ কললিস্ট দেখলাম। তাঁর মৃত্যুর মাত্র দু`দিন আগে বিকেলে কথা হলো প্রায় পনের মিনিটের মতো। একটা মিস কল দেখে আমিই কলটি করেছিলাম।  মুশতাক ভাই, `ফোন দিয়েছিলেন মনে হয়, মিস করেছি`। বললেন হ্যাঁ, "এমনিতেই তোমার খোঁজ নেয়া, বাচ্চাদের কি খবর, তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর সংসার কিভাবে চলছে, কারা আছে? ছেলে মেয়েরা তো বড় হয়েছে, অফিস করছ তো? দেখি, লকডাউন শেষ হলে সচিবালয়ে আসবো"- ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন একজন হৃদয়বান মানুষের সাথে কারও মান- অভিমান, দুঃখবোধ বা দূরত্ব থাকতে পারে? এটা কী ভাবা যায়? মানুষকে জয় করে নেয়ার অদ্ভুত, অদৃশ্য এক সম্মোহনী শক্তির অধিকারী ছিলেন মুশতাক ভাই। একই সাথে ভাবছি ,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ভরাযৌবনের উত্তাল সময়ে যাঁরা খুব কাছে থেকে দেখেছেন ও শুনেছেন তাঁরা বোধকরি এমনই হন। মানব জীবনে এ শিক্ষার কোন তুলনা হয় না।  
জয়তু, মুশতাক ভাই। 

১ শ্রাবণ,১৪২৮ বঙ্গাব্দ
১৬ জুলাই ২০২১ খ্রিঃ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭