নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 17/07/2021
আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য, কোরবানির পশু পরিবহন ও কেনা-বেচা, পরিবার-পরিজনের সাথে ঈদ উদযাপন করতে গ্রামে যাওয়া, ঈদের জামাত, কোরবানিসহ অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে সরকার ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত সব ধরনের বিধিনিষেধ শিথিল করে। আবার ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগষ্ট রাত ১২ পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর হবে। এবারের কঠোর বিধিনিষেধের সময় সব ধরনের শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধে কলকারখানা বন্ধ রাখা হলে রপ্তানি খাতে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হবে বলে পোষাক ও বস্ত্র খাতের মালিকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে গত বুধবার পোশাক ও বস্ত্র খাতের পাঁচটি ব্যবসায়িক সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিটিটিএলএমইএ ও বিজিএপিএমই’র সভাপতিগণ গুলশানে বিজিএমইএ ভবনে এক সভায় মিলিত হন। সভায় এফবিসিসিআই’র সভাপতিও উপস্থিত ছিলেন। সভায় সরকারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পোশাক ও বস্ত্র খাতের পাঁচটি ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতারা চিঠিটি প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে তাঁরা ২৩ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে দেশের বৃহত্তর রপ্তানি আয়ের পোশাক ও বস্ত্র কারখানাসহ রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানাগুলো খোলা রাখার দাবি জানান।
দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের কর্মস্থলে ধরে রাখা যাবে না। তাঁরা ছুটে যাবেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে ব্যাপকহারে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রমিকরা ওই সব অঞ্চল থেকে কর্মস্থলে ফিরে এলে করোনা সংক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাওযার আশঙ্কা থাকবে। এছাড়া বন্ধের পর কারখানা খুললে জুলাই মাসের বেতন পরিশোধে করার প্রসঙ্গ আসবে। তখন বেতন পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে।
গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এফবিসিসিআই’র সভাপতি ঈদের পর দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধে সব ধরনের শিল্পকারখানা চালু রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রপ্তানি খাতের কারখানা বন্ধ থাকলে নির্ধারিত সময়ে পণ্য রফতানি করা সম্ভব হবে না। এতে রপ্তানির ক্রয়াদেশ বাতিলের আশঙ্কা তৈরি হবে। ঈদের ছুটিসহ প্রায় ১৮-২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে গ্রীষ্ম ও বড়দিন এবং আগামী শীতের বস্ত্র খাতের ক্রয়াদেশ হাতছাড়া হতে পারে। এক মাসের রফতানি শিডিউল বিঘ্নিত হলে পরবর্তী ছয় মাসের রফতানি শিডিউলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কঠোর বিধিনিষেধে শিল্পকারখানা চালু চান। আপনি কি তাঁর সঙ্গে একমত? এই বিষয়ে প্রথম আলোর অনলাইন ভোটে দেখা যাচ্ছে যে, ৭৪ শতাংশ তাঁর সঙ্গে একমত নন, ২৪ শতাংশ একমত এবং ১ শতাংশ মন্তব্য নেই।
করোনার উর্ধ¦মুখী সংক্রমণ সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে এপ্রিল মাসে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করলেও রপ্তানিমুখী পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা চালু রাখে। গত ২৮ জুন শুরু হওয়া সীমিত ও পরে ১ জুলাই শুরু হওয়া কঠোর বিধিনিষেধে পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা চালু রাখা হয়।
গত মে মাসে রমজানের ঈদে ছুটি সংক্ষিপ্ত করা এবং সকলকে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করার নির্দেশনা দেয়া হলেও তা প্রতিপালিত হয়নি। বিশেষ করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারিদেরকে তাদের চাহিদা মতো ছুটি প্রদান করতে তারা কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে। এছাড়াও রমজানের ঈদে গণপরিবহন- বাস, রেল, নৌযান বন্ধ থাকা সত্ত্বেও সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মানুষ গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায় এবং সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে করোনা আক্রান্তের হার ও মৃত্যু প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। বর্তমান এবং কোরবানির ঈদ পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে অবশ্যই জনগণের জীবনরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে কঠোর বিধিনিষেধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন খাতে ২৩টি আর্থিক প্যাকেজে ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৩শ` ৩ কোটি প্রণোদনা ঘোষণা করে। প্যাকেজ ঘোষণার পর ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মোট বরাদ্দের প্রায় ৮৩ শতাংশ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ২৪ লক্ষ।
রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে শুধুমাত্র শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য মালিকদের দুই শতাংশ সুদে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। যেসব কারখানা তাদের উৎপাদনের ৮০ শতাংশ রপ্তাননি করে তারাই এই প্রণোদনার টাকা পাবেন। প্রায় ১৮শ` কারখানা মালিক এ ঋণ সুবিধা নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন বলে জানা যায়। ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জুন পর্যন্ত ১৪ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে।
গণপরিবহন, শপিংমল, দোকানপাঠ, পশুর হাট কোথায়ও স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দুরত্ব মানা হচ্ছে না। সড়ক, নৌ ও রেলপথে ঘরমুখো যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দুরত্ব মেনে চলার শর্তে এবং ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়ায় ঈদকে সামনে রেখে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে গণপরিবহন চালানোর অনুমতি দিয়েছে সরকার। কিন্তু সরকারের নির্দেশনা মানছে না গণপরিবহনগুলো। অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও সব আসনে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। দাঁড়িয়েও যাচ্ছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের অভিযোগ অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়ার স্থলে দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে এবং যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে তিনগুণ।
বর্ধিত ভাড়া আদায় এবং স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব না মেনে গণপরিবহন, শপিংমল, দোকানপাঠ, পশুর হাট পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে সচেতনতা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই বিষয়ে গণপরিবহন, শপিংমল, দোকানপাঠ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি এফবিসিসিআইও নিরব।
এফবিসিসিআই এবং পোষাক ও বস্ত্র খাতের পাঁচটি ব্যবসায়িক সংগঠনের সভাপতিগণসহ অন্যান্য নেতারা ঈদ পরবর্তী করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি অবশ্যই অনুধাবন করেন। এরপরও তাঁরা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিসহ বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে ঈদের পর দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধে দেশের বৃহত্তর রপ্তানি আয়ের পোশাক ও বস্ত্র কারখানাসহ সব ধরনের শিল্পকারখানা চালু রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের পোশাক ও বস্ত্র খাতসহ রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার অগ্রগতি এবং বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সাফল্যের দাবিদার শুধুমাত্র শিল্পকারখানার মালিকগণই নন। এখানে শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা। তিনটি পক্ষের সম্মিলিত প্রয়াসই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের মতে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে সংক্রমণের গতি আরও বেড়ে যাবে। তাদের আশঙ্কা আগষ্টের প্রথমার্ধ্বে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বর্তমান সংখ্যার দ্বিগুনেরও বেশি হবে। যা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক ঘটনা হবে।
ঈদের পর দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে পোষাক, বস্ত্রসহ রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা চালু থাকবে কি না, সেই বিষয়ে আজ শনিবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক হওয়ার কথা। সেই বৈঠকে ঈদ পরবর্তী ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কোনো ধরনের শিথিলতা প্রদর্শন জনস্বার্থে কাম্য নয়। তবে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন কারখানা এবং কোরবানির ঈদে সংগৃহীত চামড়া সংরক্ষণের সাথে জড়িত ট্যানারি কঠোর বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখার বিষয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এফবিসিসিআই এবং পোষাক ও বস্ত্র খাতের পাঁচটি ব্যবসায়িক সংগঠনের সভাপতিগণ রপ্তানি বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরেছেন। এছাড়াও তাদের পক্ষে জুলাই মাসের বেতন পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের শ্রমিকেরা অত্যন্ত কর্মঠ। তাদের অনুপ্রাণিত করে, সামান্য আর্থিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হলে তাঁরা স্বল্পতম সময়ে ১০-১২ দিনের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন মালিক শ্রমিক একের অন্যের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ। মালিকগণ সামাজিক দ্বায়বদ্ধতার পাশাপাশি ব্যবসা করেন। ব্যবসায় যখন লাভ লোকসান হয় তখন তিনি তাঁরাই ভোগ করেন। তাই ছুটিকালিন সময়ের বেতন দেওয়া তাদের উপরই বর্তায়।
প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান
সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং
সাধারণ সম্পাদক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭