ইনসাইড থট

বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুস সামাদ – স্মৃতি ও শ্রদ্ধায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 31/07/2021


Thumbnail

বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও ’৯৬ পরবর্তীকালের সরকারে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ড সৈয়দ আব্দুস সামাদ, যিনি এস এ সামাদ নামে সুবিশেষ পরিচিত, আমাদের প্রিয় সামাদ ভাই গত ২৮ জুলাই তারিখে লোকান্তরিত হয়েছেন এই সংবাদ জেনে মন খুব খারাপ হলো। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’ – এই পদবাক্য জানা থাকা সত্ত্বেও কোন কোন মানুষের চলে যাওয়া মেনে নেয়া কষ্টকর। সামাদ ভাই তাঁদের মতোই একজন যার স্নেহমাখা সান্নিধ্য ও দেশের বিপন্নকালে কর্ম-কৌশলের প্রভাব আরও কয়েকজন দেশপ্রেমিক হৃদয়বান মানুষের মতো আমার জীবনের অন্যতম পাথেয় হয়ে আছে।

ড সামাদের সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৬ সালে তিনি যখন জ্বালানী সচিব হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। ঢাকা ক্লাবে কয়েকজন জাপানী বন্ধুর সম্মানে একটি নৈশ ভোজের আয়োজন করেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী মাহমুদুল হক। সে অনুষ্ঠানে পরিচিত হয়ে আমি তাঁকে জানাই যে আমার সাথে ড সাত্তার ও এলেন সাত্তারের পরিচয় ছিল ও তাঁদের কাছে আপনার কথা শুনেছি। সামাদ ভাই অবাক হয়েছিলেন, কারণ সাত্তার সাহেব (১৯৬০ সালের সিএসপি অফিসার) যাকে তিনি খুবই সমীহ করতেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন ইতিহাসে বিশেষ করে পরিবার পরিকল্পনা ও সর্বজনীন শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণে ড এম এ সাত্তার ও তাঁর স্ত্রী এলেন সাত্তারের নাম যথেষ্ট উজ্বল। উল্লেখ্য যে সাত্তার সাহেব ও সামাদ ভাই দুজনেই বেশ কিছুদিন মালয়েশিয়ায় কাজ করেছেন। ‘৯৬ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা সরকারের সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত ড সামাদ মালয়েশিয়ায় Asian and Pacific Development Centre (APDC)-র অর্থনীতি ও তথ্য প্রযুক্তি পরিচালক হিসেবে ও  Association of Development Research and Training Institutes of Asia and the Pacific -এর নির্বাহী সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে অর্থনীতির কৃতি ছাত্র হিসেবে ও উন্নয়ন কাজে পেশাগত সম্পৃক্তির কারণে তাঁর অভিজ্ঞতা জানতে আমার নানামুখী প্রশ্নবাণে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে সেই সন্ধ্যাটি তিনি আমাকেই দিয়েছিলেন যার স্মৃতি আমার মনে আজও উজ্জ্বল।

কিছুদিন পরেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন কিন্তু আমার প্রতি স্নেহ ও জ্ঞান বিতরণের আগ্রহের সামান্যতম কোন ভাবান্তর বা পরিবর্তন এই মানুষটির মধ্যে আমি কখনওই দেখিনি। আমার এক সিনিয়র সহকর্মী ছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত রওশন রহমান ইভা (সিএসপি অফিসার ড মসিউর রহমানের স্ত্রী – ড মসিউর রহমান এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা); তাঁদের সাথে কর্ম সম্পর্কের বাইরেও আমার পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। সেই সূত্রে বিশেষ করে ড মসিউর রহমানের মাধ্যমে তাঁর অনেক সহকর্মী বন্ধুদের সাথে আমার পরিচয় হয়। অনেকের সাথে আজও আমার যোগাযোগ আছে কিন্তু ড সামাদের সাথে যোগাযোগ বা সম্পর্ক আমি শ্রদ্ধার সাথে সর্বদা অনুভব করেছি।

২০০১ সালের জুলাই মাসে বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন ও ১৩জন সচিবকে এক আদেশে বদলী করেন তখনই দেশে একটি অঘটন আশঙ্কার ছায়া ফুটে উঠে যা পরে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। সে সময়ে আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করার একটি বহুমুখী ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা চতুর্দিকে প্রায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানে দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। এ সময়ে আমরা যারা তরুণ উন্নয়ন কর্মী আমাদের সংগঠিত হতে উদ্বুদ্ধ ও পরামর্শ দিয়ে ঘনিষ্ট সহযোগিতা করেন ড মসিউর রহমান ও ড এস এ সামাদ। আমি ও আমার বন্ধু মিনার মনসুর (বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক) নিয়মিত এই দু’জনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছি ও অপশক্তির ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় নামে-বেনামে পত্রিকায় অসংখ্য কলাম লিখেছি। আমাদের বন্ধু শ্যামল দত্ত তার পত্রিকায় সাহস করে আমাদের সেসব লেখা ছাপিয়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ-পত্রগুলো সামাদ ভাই ও মসি ভাই দেখে দিতেন, সেগুলো পৌঁছে যেতো সুধা সদনে, আওয়ামী লীগ নেতা মোনায়েম সরকারের কাছে ও পত্র-পত্রিকায়। শ্যামল দত্ত ছাড়াও আমাদের সাথে নানা প্রতিকূলতায় সংযোগ ছিল প্রশিকার কাজী ফারুক আহমেদ, সবেক সিএসপি অফিসার নূরুল ইসলাম অনু (যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর মোশতাকের আনুগত্য অস্বীকার করে ওয়াশিংটন দূতাবাসের চাকুরী ত্যাগ করেন), মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব জাওয়াদুল করিম, সাংবাদিক আহমেদ ফারুক হাসান, ইব্রাহিম আজাদ, আমান-উদ-দৌলা, মঈনুল আলম ও সৈয়দ বোরহান কবিরের সাথে। আজ সামাদ ভাইয়ের কথা লিখতে যেয়ে অনেক কথা মনে পড়ছে, জানিনা এই মহামারী কালের দুর্বিপাকে বেঁচে যেয়ে শেষ পর্যন্ত সব কথা লিখে যেতে পারবো কী না।

২০০১ সালের পর বহুবার তাঁর বারিধারার বাসায় গেছি; অকৃতদার এই পড়ুয়া মানুষের সময় কাটতো বই পড়ে ও দেশে বিদেশে শিক্ষকতা করে। তাঁর মজলিশি আড্ডার প্রতিটি উচ্চারণে আমি কিছু না কিছু শিখতাম। মাঝে মাঝে গফরগাঁওয়ের উচ্চারণে গ্রামের বা তাঁর ছোটবেলার কোন ঘটনা বলতেন, ছিলেন সুরসিকও। মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন ড সামাদ। তিনি ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব জোনের (চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী) প্রশাসনিক প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ড সামাদের ভূমিকা নিয়ে এইচ টি ইমামের একটি মন্তব্য যার উল্লেখ আছে কাবেদুল ইসলামের ‘মুক্তিযুদ্ধে সি এস পি ও ই পি সি এস অফিসারদের ভূমিকা’ গ্রন্থে- “আমার সহকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল সৈয়দ আবদুস সামাদের…ঐ সময়ে টগবগে তরুণ। প্রখর বাঙালী জাতিয়তাবাদী এবং স্পষ্টবাদী”।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ড সামাদের একটি বই আছে, ‘যখন দুঃসময়, সুসময় : আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাঁচালী’ – এই বইটি মুক্তিযুদ্ধের একটি অসামান্য দলিলও বটে।

বেশ কিছুদিন সামাদ ভাই অসুস্থ ছিলেন। নানা ব্যস্ততায় তাঁর সাথে যোগাযোগে কিছুটা ছেদ পড়ে। প্রায়ই ভাবতাম ও বহুবার মনে করেছি সামাদ ভাইকে নিয়ে একটা লেখা লিখবো। আমরা তো জীবদ্দশায় কাউকে তাঁর উপযুক্ত সম্মান জানাই না। মারা যাবার পর নানারকম হা-হুতাশ করি কিন্তু বেঁচে থাকতে যদি অন্তত একটি কৃতজ্ঞতার মুল্যায়ন সে মানুষটির জন্যে উৎসর্গ করা যায় তা হয় সমাজের জন্যে অনুপ্রেরণামূলক। সে ক্ষুদ্র চিন্তা থেকে যখনই সুযোগ পাই জীবন চলার পথে যেসব অনুপ্রেরণাদানকারী মানুষদের সান্নিধ্য পেয়েছি বা কাছ থেকে দেখেছি তাঁদের নিয়ে লিখবার চেষ্টা করি। কিন্তু সামাদ ভাইকে নিয়ে কিছু লেখা হয়নি বলে এখন অনুশোচনা হচ্ছে ফলে মন খারাপের মাত্রাও প্রতি মুহুর্তে বাড়ছে।

আমি প্রবাদতুল্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ড এস এ সামাদের স্নেহধন্য ছিলাম, এই গর্ব আরও অনেকের মতো বাকি জীবন বহন করে যাবো।

--

রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম

ই-মেইলঃ rezasalimag@gmail.com     

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭