ইনসাইড বাংলাদেশ

মিউজিক্যাল চেয়ারে আসীন অবাস্তব বালিশের অকেজো লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 01/08/2021


Thumbnail

ছোটবেলার একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে। ইংরেজিতে অপরাপর শিক্ষার্থীদের চেয়ে একটু ভালো নম্বর পেতাম বলে মায়ের পরিবারের সদস্যদের কাছে নামডাক একটু বেশি ছিল। তো, একদিন গ্রামের এক নানাভাই এসে কাছে ডাকলেন। উদ্ভট উদ্ভট সব ট্রান্সলেশন জিজ্ঞাসা করে মাথা খারাপ করে দেয়ার মতো অবস্থা। একটি ট্রান্সলেশন এখনও মনে আছে- আকাশে উড়ন্ত থাকিবার অবস্থায় পাখিটি হঠাত ডিম পাড়িয়া দিলো।

তবে সবচেয়ে সহজ ট্রান্সলেশনটি দিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা শুরু করা যাক, ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেলো। না পাঠক, একেবারেই ভয় পাবার কিছু নেই। আমি আপনাদের ইংরেজি ট্রান্সলেশনে কতটুকু দক্ষতা আছে, তা নিয়ে মোটেই প্রশ্ন করছি না। প্রশ্ন করছি, আমাদের দেশের করোনা মহামারীর সময়কার নীতি-নির্ধারকেরা যে অহেতুক ডাক্তারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, এর দৃশ্যমান সুফলটা আসলে কোথায়? রোগী আরোগ্য লাভ করছে, এমন কথা মুখে আনাও যে পাপ!

অকার্যকর, অবাস্তব, অপরিণামদর্শী, মোট কথায় অ-যুক্ত যত উপসর্গমূলক নেতিবাচক শব্দ রয়েছে, তার সবকিছুই বাংলাদেশের লকডাউন কার্যকর করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। বিশ্বের অপরাপর দেশগুলো যখন তাদের জনগণকে বাঁচাতে মরিয়া, ঠিক তখন বাংলাদেশে যেন খেলা হচ্ছে একধরণের মিউজিকাল চেয়ার। এই মিউজিকাল চেয়ারে বসে আছে কঠোর লকডাউন, সর্বাত্মক লকডাউন, লকডাউন, বিধিনিষেধ, সবকিছু বন্ধ, গণপরিবহন বন্ধ নামক নানা প্রতিযোগিরা। তবে দুঃখের কথা হচ্ছে, কার্যকর ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নামের প্রতিযোগিকে এই প্রতিযোগিতায় না নেবার কারণে সে ঘরের এককোণায় বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। আর সে না থাকবার কারণেই আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।

গত ২৩ জুলাই থেকেই দেশে চলছে কঠোর লকডাউন। রাস্তাঘাটে কোনো যানবাহন নেই, কিন্তু মানুষ আছে। রেস্তোরাঁ খুব একটা খোলা পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ফুড ডেলিভারি সার্ভিসগুলো ঠিকই খাবার পৌঁছে দিচ্ছে মানুষের ঘরে। এটি খুবই চমৎকার একটি সিদ্ধান্ত, কারণ মানুষের ক্ষুধাপীড়িত পেট তো আর লকডাউন মানে না। কিন্তু এর মাঝেও একটি কথা আছে। এই ডেলিভারি যারা করছে, তাদেরকে টিকা দেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ এখনও আমাদের সরকারের দিক থেকে নেয়া হয়নি। সুতরাং বলা যেতেই পারে, এই খাবার পরিবহনকারী মানুষগুলোর মাধ্যমেও করোনা ভাইরাস ছড়াবার সম্ভাবনা ব্যাপকাকারে রয়েছে।

ঈদের আগে থেকেই একেবারে সাইরেন বাজিয়ে মানুষের কানে প্যা পোঁ করে বলা হচ্ছিল যে সামনে আসতে যাচ্ছে কঠোর/সর্বাত্মক লকডাউন। মানুষও যেন এই কথায় কিছুটা নড়েচড়ে বসে। আর তাদের নড়েচড়ে বসার মানে হচ্ছে ফেরি ও লঞ্চঘাটগুলোতে প্রচণ্ড ভিড়। বাস ও রেলস্টেশনে ভিড়। করোনা মোকাবিলায় সরকারের যতটা না সাফল্য, তারচেয়েও বেশি ভরাডুবি হয় এই অবাস্তব হুট করে দেয়া সিদ্ধান্তের কারণে। হঠাত করে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হলে তারা জীবিকা নির্বাহের কারণে চলে যেতে চান ঢাকার বাইরে। কারণ এই শহরে থাকলে তো আর পেট ভরছে না। এই মানুষগুলোই যখন আবার কারখানা কিংবা অফিস-আদালত খুললে মাছের ঝাঁকের মতো আসতে শুরু করে, তখন সাথে করে নিয়ে আসে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। এই ব্যাপারটি আমরা আগের কয়েকটি লকডাউনে দেখতে পেয়েছি। সংক্রমণের হার একটু কমতির দিকে থাকলে হুট করে লকডাউন দিয়ে দেয়া হয় এবং যখন তা তুলে নেয়া হয়, আবার দেখা যায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। দেশের পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ অবস্থা আমাদের ঢাকা শহরকেও পেয়ে বসেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারে আমাদের প্রিয় ঢাকা সবাইকে ছাপিয়ে হাতে ব্যাটন তুলে সামনের দিকে নিনাদ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে সগৌরবে। এই দায়গুলো আসলে কার? কে নেবে এই দায়ভার?

গত ৩১ জুলাই হুট করেই বিভিন্ন শিল্প-কারখানার মালিকেরা তাদের শ্রমিকদের ফোনে ক্ষুদে বার্তা কিংবা কল দিয়ে জানিয়েছেন ১ তারিখ থেকে খুলে দেয়া হচ্ছে কারখানা। তারা যেন চলে আসে। এমন একটি বার্তা পাঠিয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা অনন্ত জলিল ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। দিয়েই তিনি তোপের মুখে পড়েছেন। একদিনের নোটিশে কারখানার শ্রমিকেরা কেমন করে ফিরে আসবেন, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলায় “কেউ যেন অনুপস্থিত না থাকে” এই কথাটি মুছে দিয়েছেন তিনি। তবে ক্ষতি যা হবার, আগেই তো হয়ে গিয়েছে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বললনে, যারা ঢাকার বাইরে গিয়ে আটকে থাকবে, তাদের চাকরি যাবে না। পর্যায়ক্রমে ৫ তারিখের পর তাদেরকে নিয়ে আসা হবে। আসলে তিনি কেমন হিসেব করে এই কথাটি বললেন, সে ক্যালকুলেটরটি যদি আমাদের দিতেন, খুব সুবিধে হতো। অঙ্কে আমরা বোধহয় খুবই কাঁচা। এই দেশের কত শতাংশ শ্রমিক ঢাকার স্থানীয় আর কত শতাংশ শ্রমিক ঢাকার বাইরে থেকে জীবিকার তাগিদে প্রতিবছর আসেন, তা নিয়ে কি মাননীয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাহেবের কোনো ধারণা আছে? সরকার তো ঠিকই কারখানার মালিকদের কাছে নতি স্বীকার করে কোনো কঠিন পদক্ষেপে গেলো না। বরং প্রতিমন্ত্রী সাহেব বললেন যে স্বল্প পরিসরে সবকিছুই খোলা হচ্ছে। সে হিসেবে কল-কারখানাও খুলে দেয়া হচ্ছে। তবে পরবর্তীতে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সেটি নিয়ে খোলাসা করে কিছু বলেননি তিনি। আমরা আরও একটি অবাস্তব সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছি।

১) ঢাকার বাইরে যেসব শ্রমিকেরা গিয়েছিলেন, তাদের টিকাদান কর্মসূচী কি কারখানার মালিকেরা নিজ উদ্যোগে নিয়েছিলেন?

২) কতজন শ্রমিক ঢাকার বাইরে আর কতজন ঢাকায় আছে, তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা হয়েছে? স্থানীয় শ্রমিকদের নিয়ে কারখানা চালাবার মতো সংস্থান কি মালিকদের আছে?

৩) সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন যে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে করোনা আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। সরকার ও কারখানার মালিকদের সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের এই কথাটিকেই যেন তারা বাস্তবে রূপদান করতে তৎপর হচ্ছেন।   

ট্রান্সলেশনে আছে ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যায়। আমাদের জাতীয় ট্রান্সলেশনে রোগীরা পড়ে থাকে, অসুখে কাৎরায়। আর ডাক্তাররা কোনো খোঁজই পান না অসহায়দের। চিকিৎসা ব্যবস্থা করা তো ডুমুরের ফুলের মতোই দুর্লভ বস্তু।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭