ইনসাইড থট

ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে...

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 03/11/2017


Thumbnail

যুথবদ্ধ মানব সমাজ সভ্যতার শুরু থেকেই সামাজিক জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিল। আমরা কেউই কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। একে অপরের সহযোগীতায় মানুষ দাঁড়িয়েছে সেই আদিম কাল থেকেই।

একটা খবর আমাকে ভীষণ ভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছে। ফরিদপুরে একজন যুবক গনপিটুনিতে নিহত হলে, তাঁর জানাজা পড়তে ও দাফনে এলাকাবাসী বাঁধা দেয়। নিহতের বাবা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, জানাজা আর দাফন যেহেতু করতে দিবা না তোমরা তাইলে ওর লাশ নদীতে ফেলে দাও...

ঘটনাটি এই পর্যন্ত হলে ঠিক ছিলো, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো অতি উৎসাহী একদল তরুণ যুবা নিহতের লাশ সত্যিই নদীতে ফেলে দেয়। যথারীতি ঘটনার শেষে পুলিশের আগমন! তবে এখানে পুলিশ মানবিকতা ও মহানুভতার পরিচয় দিয়েছেন, তারা লাশ নদী থেকে তুলে এনে জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করেছেন।

তিনটি আদিবাসী পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়েছে গত ছয় মাস যাবত। সমাজচ্যুত এই তিনটি পরিবারের সঙ্গে গ্রামের কেউ কথা বললে তাকে দশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। আর হ্যাঁ, সঙ্গে দশখানা (একটাও কম নয়) জুতার পিটুনি। তাদের অপরাধ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে এই তিনটি দুষ্টু পরিবার ভোট দেয়নি। ঘটনাস্থলঃ তারান ইউনিয়ন, তাড়াস উপজেলা, জেলাঃ সিরাজগঞ্জ। স্থানীয় পর্যায়ে দেশের আনাচে কানাচে এই ধরনের অনেক অমানবিক কর্মকাণ্ড হয়তো প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিন্তু এই ঘটনার শিকার পরিবারের দাবি এই চেয়ারম্যানের দৃষ্টি নাকি আগে থেকেই ছিলো তাঁদের সম্মিলিত পুকুরটির ওপর। পরিবারগুলোর দাবি এই পুকুরের আয় দিয়ে আদিবাসীদের জন্য একটি মন্দির পরিচালনা করা হয়। দুঃখের বিষয় এই বিষয়ে স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিছুই জানেন না।

খুলনায় শিশু রাকিব পেটের দায়ে একটি মটর গ্যারেজে কাজ করতো। একদিন ভরদুপুরে এই রাকিবকে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো, কারণ তার পেট ফুলে উঠেছে অস্বাভাবিক ভাবে! কারন ওর গ্যারেজের মালিক তার পায়ুপথে গাড়ির চাকায় হাওয়া দেওয়ার যন্ত্রটি চেপে ধরেছিল। রাকিব নাকি কেঁদে কেঁদে বলছিলো আমি মরে যাবো তো... কে শুনে কার কথা দুই পয়সার কামলা একটু এক্সপেরিমেন্ট তো করাই যায়, তাই না? মারা গেলো সেই ছেলেটি। ফুঁসে উঠলো খুলনা, ধিক্কার জানালো সারাদেশ। দ্রুত বিচারে দোষীদের শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে মূল অপরাধীর শাস্তি কমে হলো যাবজ্জীবন, কারণ সে তো তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল এবং হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিল! আমি না বিচার আচার খুব একটা বুঝি না...

আমরা কি তবে আমদের মানবীয় মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছি? হাজার বছরের সামাজিক মানুষের এ কেমন বিপর্যয়? আমরা কেউ কি ভেবে দেখেছি, আমরা কোন পথে ধাবিত হচ্ছি? কথায় আছে, আগুন দেবালয় চেনে না। দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে, আপনি আমি রক্ষা পাবো? সেইফহোম, ভিভিআইপি প্রটোকল বাঁচাতে পারবে আমাদের? আমি আমার জীবনের অর্ধেকের (গড় আয়ুষ্কাল অনুযায়ী) বেশী সময় পার করে ফেলেছি। চল্লিশের ঘরে প্রবেশ করবো শীঘ্রই। ঘন কালো চুলে রূপোলী আভা উঁকি দিচ্ছে। কিছু বলতে চাই, এতে যদি আপনার আমার একবিন্দু সচেতনতা বাড়ে এতেই আমি সার্থক।
কিছু বিষয় একটু ভেবে দেখা যাক...

যৌথ পরিবারের বিলোপ ও একক পরিবারের উত্থানঃ এটা আমাদের ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য করেছে, বিশেষ করে পরিবারের নবীন সদস্যদের জন্য। ব্যাস্ত আমরা বাবা মায়েরা দিনের সিংহ ভাগ অফিস ও ব্যবস্যা নিয়েই কাটিয়ে দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারি ঠিকমতো? যৌথ পরিবারে দাদা, দাদী, চাচা, চাচী বা বড় ভাই বোনেরা কিন্তু পারস্পরিক যহযোগীতায় এই অভাব বুঝতে পারতো না।

আলগা সামাজিক বন্ধনঃ পাড়ায় যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা বা সিগারেট ফোঁকা ছিল এক কথায় অসম্ভব। কারন মুরুব্বীরা সেটা মেনে নিতেন না, কেউ চাচা, কেউ বা মামা, কেউ বা বাবা বা বড় ভাইয়ের বন্ধু কারো না কারোর চোখে পড়ার ভয় ছিল। আগে মুরুব্বীদের দেখলে ছেলেরা অন্যপাশে সরে দাঁড়াত এমন কি সালামও দিতো। এখন পাড়ায় মুরুব্বীদের দেখি মাথা নত করে হাঁটতে, পাছে কারো বেয়াদবি চোখে পড়ে! অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ইদানীং কালের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী আমরাই।

দ্রুত নগরায়ন ও অবৈধ প্রতিপত্তিঃ ক্রমবর্ধমান নগরায়ন আমাদের ব্যস্থতা ও আর্থিক সচ্ছলতা দিলেও অসম প্রতিযোগীতা, অস্বচ্ছ আয়ের বন্টন ও অর্থনৈতিক মেরুকরণ নিয়ে ভাবছি না কেউ। বিশেষত আইন কানুন নিয়মের তোয়াক্কা করছে না এক শ্রেণির মানুষ, যারা ক্ষমতা ও অবৈধ প্রতিপত্তির জোরে যা খুশি তাই করে যাচ্ছেন।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অন্যায় সুযোগ সুবিধাঃ আপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। এটাই সাভাবিক, কিন্তু কেউ দেখা যায় শাস্তিটাও আরামেই ভোগ করছেন। যেমন বছরের পর বছর দাগী কয়েদীরা জেলখানার বদলে হসপিটালের সুসজ্জজিত কেবিনের নরম বিছানায় বন্ধু বান্ধব এমনকি রাজনৈতিক কর্মী সমর্থকদের সাথে মিটিং বা আড্ডা দিয়ে সময় অতিবাহত করছেন। তাহলে আপনার অর্থ বিত্ত কিংবা প্রতিপত্তি থাকলে শাস্তিও হবে আনন্দময়...

মুক্ত সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবঃ বিজ্ঞানের আশীর্বাদে গোটা পৃথিবী আমাদের হাতের মুঠোয় রিমোট কন্ট্রোলে বন্দী। যা বা যারা টিভিতে অনুষ্ঠান সমূহ তৈরি করেন, তারা  তাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করেন। সকল দর্শকের সামজিক মূল্যবোধ এক নয়। এমতাবস্থায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা আসন্ন। কিছুদিন আগে একটি সিরিয়াল দেখাকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামে দুই দলের সংঘাত রক্তপাতে গড়িয়েছে পর্যন্ত। আমাদের দেশে কিছু টিভি সিরিয়াল এখন এতোটাই আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এর জন্য বিবাহ বিচ্ছে এমক কি খুন, পারিবারিক কলহ লেগেই আছে। একাধিক বিবাহ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের দুর্বোধ্য মারপ্যাচের সিরিয়ালগুলো সত্যিই কি আমাদের রুচি কিংবা সংস্কৃতির সাথে যায়?

মাদকের নানা রুপঃ হেরোইন, পেথিড্রিনের পর ফেন্সিডিল ছিলো সবচেয়ে বড় মাদক। এখন মাদকের ধরনের সীমা পরিসীমা নেই। ইয়াবা এখন সবচেয়ে বড় মাদকের নাম। শিশা লাউঞ্জের ছড়াছড়ি গোটা নগর জুড়ে। পথশিশুরা পর্যন্ত ডান্ডিতে (জুতা ছেঁড়া অংশের জোড়া লাগাতে ব্যবহৃত গ্লু বা আটা) আসক্ত হয়ে প্রকাশ্যে রাস্থায় ঝিমায়।

অনলাইনের বিড়ম্বনাঃ ঢাকা শহরে জনসংখ্যা পৌনে দুই কোটি, কিন্তু আশ্চর্যের বিহয় হলো এই নগরে ফেইসবুক আইডি আছে সোয়া দুই কোটির উপর! তার মানে আমরা নাম পরিচয় গোপন করে সক্রিয় আছি অনলাইনে। এটা কি প্রতারণা নয়? কেন করছি আমরা? কারন আমরা আমাদের মানসিকতাকে বিকৃতির নোংরা স্থরে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে কিংবা একই আড্ডায় বসেও অনলাইনে প্রতারণা করছি স্বজন বন্ধুদের।

ঘোরের মধ্যে বসবাসঃ নিজেদের যোগ্যতা কিংবা নানা কারনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কিংবা নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষন করে একটা ঘোরের মধ্যে বসবাস করে কেউ কেউ। এখানে বাস্তবতা অনুপস্থিত থাকায়, যে কোন প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে যা সমাজের জন্য শভনীয় হয় না বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই।

ভুঁইফোঁড় সংগঠন এবং রাজনৈতিক লেজুর বৃত্তিঃ জাতীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ছবির সাথে নিজেদের বিশাল আকারের ছবি যুক্ত করে কারনে অকারনে নানা অজুহাতে পোষ্টার বা ব্যানার টানিয়ে আসলে লোকজনদের জানান দেয়া হয়, তাদের যেন সমীহ করা হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই চাঁদাবাজির সুবিধার্থে। এক শ্রেণীর দুষ্টু রাজনৈতিক ব্যক্তি এই সব অপকর্মের সাথে যুক্ত থেকে সেই সব লোকদের আস্কারা দিয়ে থাকেন। এই সুযোগে তারা সমাজে যা খুশি তাই করার চেষ্টা করে।

বস্তি বসতি ও পথশিশুঃ সুরম্য অট্টালিকার পাশেই বিবর্ণ ধুষর বস্তিগুলো নিয়ে আমরা ভেবেছি কখনো? কিভাবে তারা বাঁচে? তাদের নূন্যতম নাগরিক সুবিধা কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা কি তারা পায়? পথশিশুরা, যাদের শিকড়ের সন্ধানে তারা ব্যর্থ, আর আমরাও পারিনি তাদের জন্য নিরাপদ একটা পরিবেশ নিশ্চিত করতে। স্মাগলিং, ড্রাগ ট্রাফিকিং, পিকেটিং এমনকি সন্ত্রাসের হাতিয়ার হচ্ছে তারা, কারন পিছুটান ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তার নেই।

ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাঃ বাচ্চাদের স্কুলব্যাগ বাবা মায়ের বোঝা, কারণ এতো ভার বইতে প্রস্তুত নয় আমাদের শিশুদের কোমল কাঁধ। ক্লাসের চেয়ে বেশি দৌড়াতে হয় কোচিং এর জন্য। দেশে এখন উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে, কারন ক্ষেত্র প্রস্তুন নয় এমন শিক্ষাও আছে এই দেশে। আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ছাত্র ছাত্রীদেরও ডীগ্রী দেয়া হচ্ছে। হতাশা থেকেও মানুষ ভুল আচরন করে থাকে।

বাচ্চাদের খেলার মাঠ ও পার্কের অভাবঃ মাটির মানুষ বড় হচ্ছে মাটির সংস্পর্শ ছাড়া। নগরে একের পর এক হাউজিং কোম্পানী বসতি গড়ে তুলছেন, কিন্তু বাচ্চাদের জন্য নেই নূন্যতম একটি খেলার মাঠ। ফ্ল্যাটের চারদেয়ালে বন্দী শিশুরা বেড়ে উঠছে অসাভাবিক প্রক্রিয়ায়।

আমরা কোথায় যাচ্ছি, ভাবতে হবে এখনই...

অনুপম মাহমুদ         
উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭