ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

তালেবান কি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে পারবে?


প্রকাশ: 31/08/2021


Thumbnail

দীর্ঘ ২০ বছর! ২০০১ সাল থেকে যাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের পরাশক্তি যুদ্ধ ঘোষণা করে সেই তালেবানরাই আবারো পুরো বীর দর্পে ২০২১ সালে এসে নিজ ভূমির দখল নিয়ে নিলো। অনেকটা লজ্জায় এখন কত দ্রুত দেশ ত্যাগ করা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত মার্কিনী পরাশক্তি।

১৫ আগস্ট কাবুলের পরিবেশটা আর আট-দশ দিনের মতই হতে পারতো যদি না বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে গড়ে তোলা আফগান সামরিক বাহিনী বিনা বাঁধায় তালেবান যোদ্ধাদের হাতে রাজধানীর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে পলায়ন না করতো। কোন রক্তপাত ছাড়াই বিনা যুদ্ধে যখন রাজধানীর দখল নিচ্ছিলো তালেবান ঠিক তখন হেলিকপ্টার আর গাড়ি ভর্তি করে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি, যা কিনা দেশটির সাধারণ মানুষের মাঝে তালেবানের প্রতি ভীতি আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানরা সরকার পরিচালনা করে আফগানিস্তানে। আফগান ইতিহাসে অন্যতম ভয়ানক একটি অধ্যায় ছিলো এই পাঁচ বছর। শরিয়া আইনের কথা বলে তালেবান অত্যাচারের শিকার হয় হাজার হাজার মানুষ। বিশেষ করে নারীদের প্রতি তালেবানের অত্যাচার শুধু যে স্থানীয় নারীদের জন্যই আতঙ্কের ছিলো তা নয়, বিশ্ববাসীর কাছেও এক আতঙ্কের নাম। তালেবানরা এই পাঁচ বছর দেশটিতে নারীদের শিক্ষা, ঘরের বাহিরে বের হওয়া তো দূরের কথা তাদেরকে ঘরের ভিতর পর্যন্ত বোরখা পরে থাকতে বাধ্য করত। ছেলেদের ক্ষেত্রে দাঁড়ি না রাখলে ছিলো কঠোরতম শাস্তির বিধান। গান শোনা কিংবা গান শেখা, ছবি দেখা, বিভিন্ন বিনোদন ছিলো একেবারেই নিষিদ্ধ।

ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তাদের আয়ের অন্যতম উৎস ছিলো মাদক ব্যবসা। এমনকি ক্ষমতা ছাড়ার পর মার্কিন বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অর্থের চালানে অন্যতম যোগান আসতো এই মাদক থেকেই। যদিও মার্কিন বাহিনী পপি (কোকেন বানানোর ফুল) চাষিদের বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছে এই খাত থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু দিন শেষে তালেবানের ভয়ে অনেকেই পপি উৎপাদন থেকে সরে আসতে পারেনি। যদিও এখন ক্ষমতা গ্রহণের পর তারা পপির উৎপাদন বন্ধের কথা বললেও কতটা আদৌ বন্ধ হবে কিনা তা সময়-ই বলে দিবে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির না পাওয়ার পিছনে:


১. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়া কিংবা দেরি হওয়ার পেছনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অন্তরায় হিসেবে ধরা দিবে তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নারী শিক্ষা।
২. সমন্বিত সরকার ব্যবস্থা গঠন না করতে পারলে।
৩. মাদক ব্যবসা থেকে অর্থ উপার্জন অব্যাহত থাকলে।
৪. বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী গুলোকে প্রশ্রয় এবং পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া।
৫. সাবেক সরকারের বিভিন্ন আমলা কিংবা সেনা সদস্য, সরকারী লোক ও পশ্চিমাদের সহযোগিতাকারি দো’ভাষীদের ওপর অত্যাচার অব্যাহত থাকলে।

এই বিষয় গুলো তালেবানকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে ফেলেছে। যদিও তারা বারবার বলে আসছে যে, তারা আর পুরনো তালেবান নয়। তবুও তাদের আচরণের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে সমগ্র বিশ্ব।

তালেবানকে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যে দেশটি সবচেয়ে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে তা হচ্ছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পশ্চিমা বিশ্ব এবং পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারত বারবার পাকিস্তানকে দোষারোপ করে আসলেও দেশটি কোন সময় এই বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করেনি। তালেবানরা গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী দখলে নেওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান-ই সবার আগে তালেবান ও আফগানিস্তানের মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আফগানিস্তানের জনগণ আজ দাসত্বের শিকল ভেঙ্গেছে। তার এমন মন্তব্যর পর তালেবানের প্রতি পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রীর পরোক্ষ সমর্থনের বিষয়টি সবার কাছে সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরেই তালেবানের একটি প্রতিনিধি দল ও তালেবান বিরোধী একটি জোট পাকিস্তানে এসে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেহমুদ কোরেশীর সাথে দেখা করেছে, যাতে আফগানিস্তানে একটি সমন্বিত সরকার ব্যবস্থা গঠনে পাকিস্তানের সহযোগিতা অব্যাহত থাকে।

এছাড়া তালেবানের সাথে সাবেক আফগান সরকারের মীমাংসার জন্য কাতারের রাজধানী দোহায় যে আন্তর্জাতিক বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিলো সেখানেও তালেবানের উপর পাকিস্তানের প্রভাবের কথা সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে।

পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী যদিও তালেবানের বিজয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন কিন্তু তার সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় তালেবানকে স্বীকৃতির বিষয়ে দেশটি তার আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত জানাবে। এটি তালেবানের জন্য এক বিশাল ধাক্কা বলা চলে। কারণ, ১৯৯৬ সালে যে তিনটি দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিলো তার একটি ছিলো পাকিস্তান এবং দেশটি সবার আগে তালেবানকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন বলেই মনে হচ্ছে।

তাছাড়া তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুরোপুরি ভাবে গ্রহণের পর মাত্র তিনটি দেশ- রাশিয়া, পাকিস্তান ও চীন দেশটিতে তাদের দূতাবাস চালু রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। পাকিস্তানের মতো বাকি দুটো দেশ চীন ও রাশিয়াও এখন পর্যন্ত তালেবানকে সম্পূর্ণ স্বীকৃতির বিষয়ে এখনো একমত হতে পারেনি।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে দেশটির প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, রাশিয়া এখনও তালেবান গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি বা এই গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসেনি। তালেবান আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে কতটুকু সক্ষম তা দেখার পরই কেবল তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

এছাড়া তালেবানের প্রতিনিধি দল আফগান ক্ষমতা দখলের কিছুদিন আগে চীন ভ্রমণে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। সেখানে চীনের পূর্ণ সমর্থন আদায়ে তালেবানের পক্ষ থেকে জানানো হয় উইঘুরদেরকে তালেবানের পক্ষ থেকে কোন রকমের সমর্থন জানানো হবে না।
তাছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও তালেবানদের সাথে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও এখনি কোন রকমের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানে আগ্রহ নয় তারা।

কিভাবে তালেবানের পক্ষে স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়া সম্ভব:

তালেবানই শাসনের ভয়াবহ পাঁচ বছরের কথা এত সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এই কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবানের মিষ্টি কথায় এবার এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করবে না, এটা খুব স্বাভাবিক। তালেবানকে নিজেদের কিছু বিষয় দিয়ে খুব দ্রুত প্রমাণ করতে হবে যে তারা আর আগের মত অবস্থায় নেই। তারা এখন অনেক বেশি শৃঙ্খল এবং দেশ পরিচালনায় যোগ্য। তবে যে বিষয়গুলোকে সবার আগে পরিষ্কার করতে হবে তা হল-
১. নারীদের প্রতি নমনীয়তা। তাদের সঠিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং পুরুষের সাথে শরিয়া মোতাবেক-ই কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
২. আরেকটি বেশ ভয়াবহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অন্যান্য জিহাদি গোষ্ঠী গুলোকে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়া। 
৩. মাদক ব্যবসায় লাগাম টেনে ধরা এবং
৪. একটি সমন্বিত সরকার ব্যবস্থা গঠন করা।

এই বিষয়গুলোর প্রতি তালেবানদের জোরের উপর নির্ভর করছে তালেবানের পক্ষে কত দ্রুত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব। দেশটির ৩ কোটি ৬০ লাখ জনগোষ্ঠীর মাঝে থাকা পশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক, আইমাক, তুর্কমেন, বালুচ, পাশাই, নুরস্তিনি, গুজ্জর, আরব, ব্রাহুই, কিজিলবাশ, পামিরি, কিরগিজ, সাদাত মত জনগোষ্ঠী নিয়ে যদি তালেবান একটি সমন্বিত সরকার ব্যবস্থা গঠন করতে সক্ষম হয় তবে ধরেই নেওয়া যায় দেশটিতে চলে আসা এত দিনের যুদ্ধ অবস্থার কিছুটা উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।

এক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকা হবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তালেবানকে ক্ষমতায় বসাতে দেশটি বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও এখন তাদের উপর দেশটিতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্যও বেশ কষ্ট পোহাতে হবে তা আর বলে না দিলেও চলবে। কারণ আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার সাথে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতাও অনেকাংশে নির্ভরশীল। 

বেজিন-সাদ্দাত সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সামরিক বিশেষজ্ঞ ড. ইয়াদো হেখট বলেন, তালেবানকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া দেশ হতে পারে চীন ও পাকিস্তান। কারণ আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের সীমান্ত রয়েছে এবং সরাসরি প্রভাবিত হবে।

হেখট আরও বলেন, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে আমি মনে করি বিষয়টি তালেবানের আচরণের ওপর নির্ভর করছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় ও অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পার্থক্য রয়েছে। তালেবান যদি স্থিতিশীল শাসন জারি করতে পারে তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে অনাগ্রহী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পথে হাঁটতে পারে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭