ইনসাইড এডুকেশন

বাংলাদেশে ‘শিক্ষা’ কি সবচেয়ে মূল্যহীন?


প্রকাশ: 12/10/2021


Thumbnail

বাংলাদেশে এখন উন্নয়নের জয়গাঁথা চলছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। উন্নয়নের এত যজ্ঞের মধ্যে শিক্ষা যেন অপাংক্তেয় একটা বিষয়। যেন সবচেয়ে গুরুত্বহীন একটা জিনিস। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমরা দেখলাম করোনার সময়। 

মহামারী করোনায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ডিজিটাল সুবিধা অর্থাৎ ইন্টারনেটের আওতাভুক্ত হতে পারেনি। সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু টেলিভিশন, ইন্টারনেট, কমিউনিটি রেডিও এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যেসব দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে তাতে অংশগ্রহণ করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। পাশপাশি এই সময় জ্যামিতিক হারে বেড়েছে ঝরে পড়ার সংখ্যাও। প্রায় দেড় বছর দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। আর দোহাই দেয়া হয়েছিল করোনার, যদিও একই সময়ে গার্মেন্টস থেকে শুরু করে সব কিছুই চলেছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলার জন্য একটি শিক্ষা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার কথা দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষাবিদরা বলছেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় কমে যাওয়ার ফলে, তাদের ও সন্তানদের লেখাপড়া এবং জীবন-জীবিকা বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করাও দুরূহ। পাশাপাশি শিক্ষকদের অবস্থাও করুণ। প্রাথমিক শিক্ষকদের অনেকেই দক্ষভাবে পড়াতে পারছেন না। একই অবস্থা এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও। ফলে সামগ্রিকভাবে গোটা জাতির শিক্ষা চালানোর জন্য যে ধরনের বিনিয়োগ, ক্যারিশমেটিক লোকবল দরকার, আর তার কতটা আমরা মেটাতে পেরেছি আর কতটা এখনো হয়ে ওঠেনি, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষাবিদেরা।

একটি সমাজ বা দেশ কতটা সভ্য হবে সেটা শেষ বিচারে শিক্ষকরাই নির্ধারণ করে থাকেন। শিক্ষকরা যত বেশি মানসম্পন্ন হবেন, তত বেশি মানসম্পন্ন হবে দেশ। অথচ আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলিতদের কথিত তালিকায় কৃষকদের পরই শিক্ষকদের স্থান । 

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক একটি বিদ্যালয়ে ৩ ঘণ্টা ক্লাস নেন, সম্প্রতি গণমাধ্যমে এরকম খবর প্রকাশিত হয়। শোনা যায়, ভদ্রলোক প্রথমে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পরে পুনরায় প্রস্তুতি নিয়ে বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে টিকেছেন, এবং শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছেন। এই ভদ্রলোক ভালো একটি সুযোগ পেলেও অধিকাংশ শিক্ষকদের মন্দ ভাগ্য। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষকই নিজ নিজ জায়গা থেকে হতাশাগ্রস্ত। আর এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক শিক্ষায়। গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২! সেই ইনডেক্সে ভিয়েতনামের অবস্থান ৬৬, ভারতের অবস্থান ৭৭, শ্রীলংকার অবস্থান ৮৭, ভুটানের অবস্থান ৯৪, আফ্রিকার রুয়ান্ডার অবস্থান ৯৯, আফ্রিকার ঘানার অবস্থান ১০১,  নেপালের অবস্থান ১১০, পাকিস্তান ১১১ তারপরই বাংলাদেশ। 

ইউনেস্কো বলেছে, একটি উন্নত রাষ্ট্র হতে হলে সেই দেশকে তার জিডিপির অন্তত ৫% শিক্ষায় বরাদ্দ দিতে হবে। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের মাত্র ১১.৯২%।  জাতীয় আয়ের (জিডিপি) হিসেবে তা ২.০৮ শতাংশ। অর্থাৎ জাতিসংঘ যা সুপারিশ করছে তার অর্ধেক বরাদ্দ হয়েছে মাত্র।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইশতেহারেও স্পষ্ট তিনটি বৈপ্লবিক চালিকা শক্তিকে সামনে রেখে জনগণকে যুদ্ধে নামার আহ্বান করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ চলবে সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং মানবিক মর্যাদাভিত্তিক। এরপর ৭২ এর সংবিধানেও সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাটি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল। আমাদের সংবিধানের ১৭(ক) ধারায় বলা আছে, ‘রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য...কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ তবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর মাত্র কয়েক বছর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এই নীতি অনুসৃত হয়েছিল। তারপর থেকে বিভিন্ন পদ্ধতি ও ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়, যা এখনো বলবত এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রতাপের অধিকারী। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ফেসবুকে নিজের আইডি থেকে পোস্ট করা এক স্ট্যাটাসে লেখেন, বাংলাদেশই হলো একমাত্র দেশ যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হলো রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। যেখানে রাষ্ট্রের কোন বেতনভোগ চাকরিজীবীকে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির বলাটাইতো একটা অপমান। কাউকেই তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে ভাগ করাই হলো অসভ্যতা। আর সেখানে ছোট ছোট শিশু যারা আগামী দিনের বাংলাদেশকে গড়বে তাদের শিক্ষক হলো রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। আবার বলে শিক্ষাই নাকি জাতির মেরুদণ্ড। যারা মেরুদণ্ড তৈরি করবে সেই কারিগরদের এমনভাবে অপমান করে আপনি কিভাবে একটি সভ্য জাতি গঠন করবেন? 

একই স্ট্যাটাসে তিনি ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেলের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে লেখেন, ভারতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের প্রতিষ্ঠানের একজন অধ্যাপকের বেতন হলো ২.৫ লক্ষ টাকা। ভারতের লিভিং এক্সপেন্স বাংলাদেশ থেকে কম। গাড়ির দাম অনেক কম, গাড়ির তেলের দাম কম। আর বাংলাদেশে বড়জোর ১ লক্ষ টাকা বা একটু কম বেশি। এই হলো শিক্ষা ও গবেষণার মূল্যায়ন। আবার প্রশ্ন করেন শিক্ষকরা কেন পার্ট টাইম অন্যত্র পড়ায়? শিক্ষকরাতো পাজেরো চালায় না! ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পার্ট টাইম পড়ানো কি খুব আনন্দের? শিক্ষকরা কি আনন্দে খুশিতে পার্ট-টাইম পড়ায়। একই কথা খাটে স্কুল কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। কেউ কি আনন্দে আর খুশিতে প্রাইভেট আর কোচিং এ পড়ায়? এইসব বিশদ ভাবে ভেবে এর উৎসমূলে সমাধান না করলে এইসব  চলবেই। যতদিন এসব চলবে ততদিন গবেষণা, শিক্ষকতা কোনটিই সঠিকভাবে চলবে না বলেও দাবি করেন তিনি।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার অবলম্বন হচ্ছে জনশক্তি এবং শিক্ষিত জনশক্তি। ভারতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হতে হলে শিক্ষাগত যোগ্যতা পিএচডিসহ কিছু বিষয়ে সর্বনিম্ন কত নম্বর পেতে হবে, তা নির্ধারিত থাকে। এটাকে বলা হয়, পে প্রটেকশন। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক একজন সচিবের সমান বেতন পেয়ে থাকেন। যার ফলে মেধাবী, দক্ষ, যোগ্যতাসম্পন্ন, ভালো ছেলেরা শিক্ষকতায় আসে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশা মর্যাদাহীন। যারা আর কিছুই পারছেন না, তারাই শিক্ষকতায় আসছেন। অপর দিকে স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত সাতটি শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। সরকার একজন দেশবরেণ্য শিক্ষকের নেতৃত্বে একদল শিক্ষাবিদ দিয়ে এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকার তাদের আমলে তৈরি শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করেনি। এইটা একটা চরম ধাঁধা। আমরা যতদিন না এ ধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো, ততদিন শিক্ষার স্বাদ পাওয়া অসম্ভব বলেও মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭